আইতানা বোনমাতি
ছবি: আইতানার ফেসবুক থেকে

আপনি যখন স্পেনের কাতালোনিয়ার মতো একটা জায়গায় বড় হবেন, না চাইলেও সব কিংবদন্তির নাম ঘুরেফিরে আপনার কানে আসবে—জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটস, মেসি...। কেন, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

বার্সেলোনা থেকে গাড়িতে ৪০ মিনিট দূরত্বে আমার শহর। মনে আছে, সেখানকার বারে বসে খেলা দেখতাম। জাভি আর ইনিয়েস্তার ওপর থাকত আমার পূর্ণ মনোযোগ। কীভাবে ওরা দৌড়ায়, কীভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করে, বলটা পায়ে নেওয়ার আগে কীভাবে চট করে আশপাশটা দেখে নেয়—সবই রীতিমতো গিলতাম। আজ মনে হয়, তাদের মতো করে খেলাটা আমিও বুঝি। খেলার এই ভিন্ন কৌশলকে আপনি বলতে পারেন ‘বার্সা পদ্ধতি’।

বার্সেলোনার পরিবেশ আইতানাকে ফুটবলার হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে
ছবি: রয়টার্স

এই মাঠ আমার নয়

আমার সম্ভাবনা ছিল শূন্যের কোঠায়। সত্যি বলছি—শূন্য।

সবাই ক্যাম্প ন্যুতে খেলার স্বপ্ন দেখত। ১৪ বছর বয়সে যখন প্রথম এই মাঠে পা রাখি, মনে আছে ৯০ হাজার দর্শক ধারণক্ষম গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মাথা ঘোরাচ্ছিল। কিন্তু ভুল বুঝবেন না। আমি যখন বলছি, ‘সবাই ক্যাম্প ন্যুতে খেলার স্বপ্ন দেখত’—এখানে ‘সবাই’ মানে আদতে শুধু ছেলেরা।

আর মেয়েরা? পাগল! কল্পনাই করতে পারত না।

আরও পড়ুন

ইনজুরিতে পড়ে যেভাবে ইংরেজি শিখলেন ব্রাজিলের এই খেলোয়াড়

সে সময় বার্সার নারী দলের খেলা টিভিতে দেখাত না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মেয়েরা ক্যাম্প ন্যুতে খেলবে, কেউ ভাবতেই পারত না।

তাই বার্সার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলার সময়ও মনে হতো, ফুটবল কিছুতেই আমার রুটিরুজি হতে পারে না।

বিশ্বকাপজয়ী দলের মিডফিল্ডার আইতানা বোনমাতি জিতেছেন গোল্ডেন বল
ছবি: এএফপি

ইতিহাসের অংশ

একসময় বার্সার নারী দলের হয়ে ক্যাম্প ন্যুতে খেলার সুযোগ হলো ঠিকই, কিন্তু মহামারির কারণে গ্যালারি তখন জনশূন্য। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে যখন আবার সেই ক্যাম্প ন্যুতেই রিয়েল মাদ্রিদের মুখোমুখি হলাম, ভাবতেও পারিনি কত বড় চমক অপেক্ষা করছে।

হ্যাঁ, ক্লাসিকো বলে কথা। কিন্তু আমরা তো মাত্র কয়েক হাজার দর্শকের সামনে খেলে অভ্যস্ত। ভাবছিলাম, বার্সেলোনায় যেহেতু আমার পরিবার, বন্ধু, স্বজনদের অনেকে আছে, গ্যালারিতে অন্তত ১০০ জন সমর্থক তো পাব।

কেমন টিকিট বিক্রি হচ্ছে, জানতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখছিলাম। একেকটা হালনাগাদ পোস্টের বিপরীতে আমার অভিব্যক্তি ছিল অনেকটা এমন:

‘আমরা ২৫ হাজার টিকিট বিক্রি করে ফেলেছি।’—বাহ!

‘৫০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।’—সত্যিই?

‘সব টিকিট শেষ।’—যাহ...অসম্ভব!

সত্যি বলছি। আমি ভেবেছি কোথাও ভুল হয়েছে। গ্যালারিভর্তি দর্শক মানে তো আমরা নারীদের ফুটবলে দর্শকের রেকর্ড ভেঙে ফেলতে যাচ্ছি, এটা কি সম্ভব? আমি ধরেই নিয়েছিলাম, টিকিট কাটলেও অনেকেই আসবে না। তা ছাড়া আগের দিন বৃষ্টিও হয়েছিল।

আরও পড়ুন

‘মেয়েটার মধ্যে একটা কিছু আছে…ও অন্য রকম’

আইতানা বোনমাতি
ছবি: আইতানার ফেসবুক থেকে

যখন টানেল দিয়ে মাঠে ঢুকলাম, বুঝলাম অসম্ভবই সম্ভব হয়ে গেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের অ্যানথেমের জন্য যখন সার বেঁধে দাঁড়িয়েছি, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। চারপাশে তাকিয়ে মাথা ঘোরাচ্ছিল, যেমনটা সেই ছোটবেলায় হয়েছে।

সেই খেলায় মাদ্রিদকে আমরা ৫-২ গোলে হারাই। দুটি স্মৃতি আমার স্পষ্ট মনে আছে। প্রথমটা হলো—যখন বার্সার পক্ষে দ্বিতীয় গোলটা করে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে আনি। আর দ্বিতীয় স্মৃতি—যখন ঘোষক বলছিলেন, ‘আজ ক্যাম্প ন্যুতে উপস্থিত আছেন ৯১ হাজার ৫৫৩ জন দর্শক। আজ আমরা সবাই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছি।’

সবাই চিৎকার করছিল। আর আমার শুধু মনে হচ্ছিল, আমরা তাহলে পেরেছি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত