উচ্চশিক্ষার সব তথ্য যেখানে পাওয়া যাচ্ছে এক ছাদের নিচে

২৩ ও ২৪ জুলাই ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিন ধরে চলবে এই উৎসব
ছবি: প্রথম আলো

৪০ বছর আগে এইচএসসি পাস করে যখন বের হই, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেকগুলো অপশন বা বিকল্প আমার ছিল না। যত দূর মনে পড়ে, আমরা যাঁরা বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেছিলাম, তাঁদের জন্য ছিল মেডিকেলের একটি, বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রকৌশল ও স্থাপত্য নিয়ে দুটি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তিনটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে চারটি সুযোগ। এর মধ্যে গোটা তিনেকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমার ঠিকানা হয়েছিল বুয়েটে। ৪০ বছর পর যখন এবারের এইচএসসি উত্তীর্ণদের ভর্তির কথা ভাবি, তখন আমার নিজেরই কেমন যেন লাগে। দেশে এখন ১৫০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আছে তিন শতাধিক বিষয়। আমার আগ্রহের জায়গা বলে জানি, কেবল কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়তে চাইলে একজন শিক্ষার্থী ৯০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের একটিতে ভর্তি হতে পারে! অন্যান্য বিষয়েও নিশ্চয়ই তা-ই। তাহলে সদ্য এইচএসসি উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী কেমন করে সিদ্ধান্ত নেবেন। শিক্ষার্থীরা যেহেতু খোঁজ খবর রাখেন, কাজেই তাঁরা শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানেন। কিন্তু তাঁদের অভিভাবকদের জন্য কাজটা কঠিন। কারণ তাঁদের নিজেদের সময়ে এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না।
আমাদের সময়ে বিকল্প কম থাকায় আমরা পড়তে খরচ কেমন, শিক্ষকেরা কেমন, শিক্ষার মান কেমন, এগুলো নিয়ে ভাবতাম না। কিন্তু এখন তো এগুলো ভাবার বিষয়। আর এসব তথ্য একসঙ্গে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতেই ‘জিপিএইচ ইস্পাত–প্রথম আলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি উৎসব ২০২৩’। ২৩ ও ২৪ জুলাই ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিন ধরে চলবে এই উৎসব। ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নানা রকম তথ্যের পসরা নিয়ে উপস্থিত আছে। পাশাপাশি থাকছে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ইএমকে সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠান, যারা উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করে।

বেড়েছে উচ্চশিক্ষার সুযোগ
তিন দশক আগে দেশে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন করা হয়। বেসরকারিভাবে দেশে এখন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অর্ধশতাধিক হয়েছে। এই সবই একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন প্রচেষ্টার অংশ। তিন শিল্পবিপ্লব পেরিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে আঙিনায় বিশ্ব এসে পড়েছে, সেখানে জ্ঞানই প্রকৃত সম্পদ। মাত্র ৫৫ জন কর্মী এমন অ্যাপ বানাতে পারে, যার মূল্যমান (ভ্যালুয়েশন) ১৯ বিলিয়ন ডলার। কিংবা ‘মানুষের মতো করে’ লিখে কথোপকথন করতে পারে, এমন চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মূল্যমান ২৯ বিলিয়ন ডলার! ২০০১ সালে, এই শতকের শুরুতে টাইম ম্যাগাজিন তাদের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে ঘোষণা করেছিল ‘জ্ঞানই হবে নতুন সহস্রাব্দের আসল সম্পদ’।

দেশের দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এখন বিরাটসংখ্যক ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারেন। তাঁদের অনেকেই নিজ জেলা বা পার্শ্ববর্তী জেলায় এ সুযোগ পেতে পারেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও এখন ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। গত তিন দশকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তাই অনেক গুণ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়লে তাঁদের বিরাটসংখ্যকই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যেতেন। সেই সঙ্গে যেতেন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশের মেধাবীদের একটি অংশ, যাঁরা শিক্ষা-গবেষণায় আগ্রহী হয়ে বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাঁদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনাদি ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে তাঁদের অনেকেই এখন দেশে ফিরে আসছেন। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসার ও বিকাশে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে দেশেই এমন সব শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নানা রকম তথ্যের পসরা নিয়ে উপস্থিত এ আয়োজনে
ছবি: প্রথম আলো



কত কী বিষয়
শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, তা নয়, নতুন অনেক বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। বিষয়ের জন্য অবকাঠামো তৈরি এবং বিষয়ভিত্তিক যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা, ভবন বানানো ও শিক্ষকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হয় সরকারি বরাদ্দ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন পেলে বেসরকারি খাত সহজে অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা তৈরি করে ফেলতে পারে। সে জন্য দেখা যায়, এখন শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেটা সায়েন্স, এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ, ফ্যাশন ডিজাইন ও ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, গার্মেন্টস টেকনোলজি, অ্যাপারেলস ম্যানেজমেন্ট, এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট, অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, শিপিং অ্যান্ড মেরিটাইম সায়েন্স, রিয়েল এস্টেট, গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকস, শিল্প ব্যবস্থাপনা, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি ইত্যাদি নতুন নতুন বিষয়ে ডিগ্রি নিতে পারেন। আবার বিজনেস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ডেটা অ্যানালিটিকস, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা, রোবোটিকসের মতো নতুন চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আলাদাভাবে জোর দেওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন। তাঁদের জন্য দরকার অনেক যোগ্য শিক্ষক। ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ইন এডুকেশনের ব্যাপ্তি এখন অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগও সম্প্রসারিত হয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান শিক্ষকদের মান উন্নয়ন ও নতুন যোগ্য শিক্ষকপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্নাতকোত্তর পড়ালেখায় গবেষণার সুযোগও বেড়েছে, যা কিনা গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষক তৈরিতে সহায়তা করছে।

দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ
একটা সময় ছিল দেশে কেবল গাজীপুরের ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা ডুয়েট) কারিগরি শিক্ষা তথা পলিটেকনিকে পড়া ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পেতেন। এখন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ অবারিত হয়েছে। মনে রাখা দরকার, এ ধরনের প্রকৌশলীদের অনেকে কর্মজীবনকে ব্যাহত না করেই উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁদের জন্য সপ্তাহান্তে বা সন্ধ্যকালীন কোর্স চালু করেছে। অবশ্য এসব কোর্স কেবল ডিপ্লোমা প্রকৌশলীই না, নানা শ্রেণি–পেশার কর্মীদের জন্যই উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া সহজ করে দিয়েছে। প্রচলিত মাস্টার্সের পরিবর্তে এসব কর্মীর প্রয়োজন এক্সিকিউটিভ ও প্রফেশনাল ডিগ্রি। এ জন্য এক্সিকিউটিভ বা প্রফেশনাল এমবিএর মতো কোর্সের সংখ্যা বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমার মতো কোর্স ভিন্ন বিষয়ের স্নাতকদের জন্য কম্পিউটারবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ করে দিচ্ছে। পেশাজীবীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে ইনস্টিটিউট ও সেন্টার। সেগুলোয় এনার্জি, কম্পিউটার, ভাষাশিক্ষা, রোবোটিকস ও ইন্টারনেট অব থিংসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এসব সেন্টার ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে রয়েছে গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, পাবলিক হেলথ, পিস অ্যান্ড জাস্টিস, এনার্জি ডেভেলপমেন্ট, ভিএলএসআই টেকনোলজি ইত্যাদি।

আছে বৃত্তি
বেসরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাতাদের অনুদান এবং শিক্ষার্থীদের টিউশন ও অন্যান্য ফি থেকে প্রাপ্ত অর্থে পরিচালিত হয়। এটা দিয়েই তাদের অবকাঠামো ও শিক্ষার ব্যয় মেটাতে হয়। আইন অনুসারে সব বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক অর্থাৎ তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নেই ব্যবহৃত হয়। স্বভাবত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা খরচ সরকারিগুলোর চেয়ে বেশি। তবে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অদম্য মেধাবীদের জন্য নানা রকম বৃত্তি ও ছাড়ের সুযোগ আছে। চার শিক্ষাবর্ষেই মেধাবৃত্তি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী খুবই কম খরচে তার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করতে পারে। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বহন করে।
এটা ঠিক যে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এক নয়। হওয়ার কথাও নয়। শতবর্ষীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিন দশককালের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের তুলনা চলে না। তবে বর্তমানে মানসম্মত ফ্যাকাল্টি, মনোরম ক্যাম্পাস, স্টেট অব দ্য আর্টস ল্যাব, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সেন্টার ও ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মাধ্যমে একটি অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ও দ্রুত একটি উন্নত মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। এ জন্য দরকার প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্ক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং সর্বোপরি শিক্ষাই আগামীর প্রধান হাতিয়ার—এই উপলব্ধি।
সরকারি ও বেসরকারি মেলবন্ধনেই কেবল তা বাস্তবায়িত হবে। জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকুক।

লেখক: প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক