বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কীভাবে নিজেকে তৈরি করব
বিশ্ববিদ্যালয় একটা নতুন জগৎ। এ জগতে পা রেখে কেউ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, কেউবা আবার খেই হারান। পড়ালেখার চাপ, নতুন পৃথিবীতে পা রাখার রোমাঞ্চ সামলে স্নাতকের চার বছরে কীভাবে নিজেকে তৈরি করবেন? পরামর্শ দিয়েছেন অগমেডিক্স বাংলাদেশের হেড অব পিপল এবং রিস্টার্ট ইয়োরসেলফের লাইফ কোচ জাভেদ পারভেজ
প্রথম বর্ষ
১. যে বিশ্ববিদ্যালয় বা যে বিষয়েই ভর্তি হন না কেন, প্রথম বর্ষে পড়াশোনার প্রাথমিক ধারণাটা সুদৃঢ় করে নিতে হবে। অনেকে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পান না। অনেকে আবার না বুঝে বিষয় নির্বাচন করে ফেলেন। যা-ই ঘটুক, মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় সব ধরনের সুযোগই ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক। তবে এটাও ঠিক, সামনে আরও সুযোগ আসবে।
২. উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মধ্যে বেশ ফারাক আছে। তাই প্রথম বছরে পড়াশোনায় একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
৩. অনেকে উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা মাধ্যমে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ার কারণে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। শিক্ষক বা সিনিয়রদের সহায়তা নিয়ে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে।
৪. আগ্রহের দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় যা করতে চাই, সে বিষয়ে হয়তো পড়ার সুযোগ পাই না। অনেক সময় আবার পরিবার অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়। আগ্রহ না থাকলে খুব বেশি দূর এগোনো যায় না। তবে অন্তত আগ্রহের জায়গাটা ঠিকঠাক জেনে গেলে পরে জীবনের মোড় ঘোরানোর সুযোগ থাকে।
৫. এ সময় আমাদের বন্ধুত্ব করতে হবে। নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোতে যুক্ত হতে হবে। মনে রাখবেন, এখনকার পড়ালেখা শুধু সনদনির্ভর নয়।
দ্বিতীয় বর্ষ
১. দ্বিতীয় বর্ষে আমরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত হতে পারি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এসব কাজে অংশ নেওয়া দরকার।
২. ইংরেজিতে কথা বলা, উপস্থাপনা, বাংলা বা ইংরেজিতে লেখালেখি—এ দক্ষতাগুলো ঝালাই করে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকায়, অনলাইনে বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপন যদি দেখেন, দেখবেন প্রায় সব চাকরির পূর্বশর্তেই বিষয়টি যুক্ত থাকে—ভাষাদক্ষতা। ইংরেজি জানলে একাডেমিক ফলাফলেও ভালো করার সুযোগ থাকে। আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
৩. দ্বিতীয় বছর থেকে আমরা বিভিন্ন নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারি। অ্যালামনাইদের অনুষ্ঠান, সেমিনারসহ নানা অনুষ্ঠানে আয়োজকদের দলে ভিড়ে যান।
৪. আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য টিউশনি করতে পারেন। ফ্রিল্যান্স বা খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত হতে পারেন। শুধু টাকার প্রয়োজন বলেই নয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনা শেখা কিন্তু খুব জরুরি। কীভাবে সঞ্চয় করব, আয়-ব্যয়ের মধ্যে কীভাবে সামঞ্জস্য রাখব, এসব বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই শেখা দরকার। তা ছাড়া বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা নিলে ভবিষ্যতে চাকরি পেতেও সুবিধা হবে।
৫. একাডেমিক প্রয়োজনে বা ভবিষ্যৎ চাকরিজীবনের জন্য যে ধরনের কম্পিউটার দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো ঝালাই করে নিতে হবে। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড থেকে শুরু করে মাইক্রোসফট এক্সেল, ডিজাইনের কাজ, ভিডিও সম্পাদনা, কিংবা যে ধরনের সফটওয়্যারে আপনার আগ্রহ আছে, সেসবের কাজ শিখে নিতে পারেন।
তৃতীয় বর্ষ
১. প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে কেস কম্পিটিশন, কোনো সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। মনে রাখবেন, কেবল পুরস্কারের জন্যই কিন্তু আপনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন না। সৃজনশীলতার বিকাশই এখানে বড়। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দলগত কাজের অভিজ্ঞতা হয়, নিজের গণ্ডির বাইরেও নানা খাতের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, আবার কীভাবে পড়ালেখা আর প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি—দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হয়, সেই সময় ব্যবস্থাপনাও শেখা যায়।
২. নেতৃত্বের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য তৃতীয় বর্ষ একটা ভালো সময়। বিভিন্ন ক্লাবের ছোট-বড় দায়িত্ব আগ্রহ নিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিন। হোক স্রেফ মঞ্চ সাজানো কিংবা পুরো ক্লাবের দেখাশোনা—দায়িত্ব যা-ই হোক, এর মধ্য দিয়েই কিন্তু নেতৃত্বের চর্চা হবে। মিলেমিশে কাজ করা একটা বড় শিক্ষা।
৩. ভবিষ্যতে যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, নিজের ‘আইডিয়া’ পরখ করে দেখার এটাই সেরা সময়। উদ্যোক্তা হওয়ার পথে ব্যর্থ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কাজেই ব্যর্থতার স্বাদ যত আগে পাওয়া যায়, তত ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই আপনার জেনে ফেলতে হবে—কোন পথে এগোনো বাস্তবসম্মত, কোনটা নয়।
৪. ভবিষ্যতে যাঁদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে আছে, তাঁদের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির খোঁজখবর রাখতে হবে। বিদেশে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুযোগ-সুবিধা-অসুবিধাগুলো জেনে নিতে পারেন।
৫. পেশাগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (যেমন লিংকডইন) নিজের প্রোফাইল গড়ে তুলতে হবে। অনলাইনেও নেটওয়ার্ক গড়তে হবে।
চতুর্থ বর্ষ
১. কেবল চাকরির জন্য নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন-সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্যও ভালো সিভি তৈরি করতে হয়। অতএব সিভি তৈরি করে সে অনুযায়ী চাকরির খোঁজ করা, আবেদন করা, ইন্টারভিউতে অংশ নেওয়া দক্ষতা বাড়ানোর এটাই সময়। সিভিতে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে, সেটাও নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করতে হবে।
২. ইন্টার্নশিপ অর্থাৎ শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ বরাবর ই–মেইল করুন, কিংবা নিজে গিয়ে কথা বলুন। জানুন, শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের প্রক্রিয়াটা কী?
৩. বিদেশে পড়তে যেতে চান যাঁরা, এ সময় আইইএলটিএস, জিআরইর মতো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখবেন, প্রথমবারে কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও আসতে পারে। একাধিকবার চেষ্টা করার মানসিকতাও থাকতে হবে।
৪. গবেষণায় যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা এমন বিষয়ই গবেষণার জন্য বেছে নিন, যা পরে জার্নালে প্রকাশ করার সুযোগ আছে। স্রেফ স্নাতক পাসের জন্য একটা ‘তুলনামূলক সহজ’ থিসিসের বিষয় বেছে নেবেন না। বরং এমন বিষয়ে কাজ করুন, যা নিয়ে আপনার আগ্রহ আছে, যা নিয়ে ভবিষ্যতেও কাজ করতে চান। প্রয়োজনে শিক্ষকদের সহায়তা নিন।
৫. যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, সেগুলো নিয়মিত পেশাদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরুন। ইদানীং চাকরিদাতারা ইন্টারভিউ নেওয়ার আগে চাকরিপ্রার্থীর মানসিকতা বোঝার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল পর্যালোচনা করেন। কাজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান নিয়ে হেলাফেলা করা যাবে না।