বুদ্ধদেব বসুর পঞ্চপদী

ছবি: খালেদ সরকার
বুদ্ধদেব বসুর রন্ধন প্রণালি অনুসরণে ইলিশের চারটি পদ রান্না করেছেন রান্ধনশিল্পী মাসুমা আলী রেখা

ইলিশ মানেই বাঙালির উৎসব। ইলিশ মানেই কাব্য, গল্পগাছার আসর। ইলিশ নিয়ে কাব্যকথায় ভূতপূর্ব পূর্ব বাংলার লেখকেরা যে কথার ইন্দ্রজাল তৈরি করে গেছেন, তার তুলনা নেই। আদর্শ উদাহরণ সিলেটের মানুষ সৈয়দ মুজতবা আলী। টিলা, কমলালেবু আর হাওড় এলাকার মানুষ আলী সায়েব যখন ইলিশ নিয়ে বাংলা সাহিত্য মাতিয়েছেন, তখন পদ্মার তীরের বিক্রমপুরে বড় হওয়া বুদ্ধদেব বসু বাদ যাবেন কেন?

জলের উজ্জ্বল শস্য ইলিশ
ছবি: মো: মাছুদুর রহমান

কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া বুদ্ধদেব বসুর প্রথম জীবন কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, বিক্রমপুর ও ঢাকায়। এ ছাড়া পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় তিনি কাটিয়েছেন জীবনের প্রথম ভাগের গুরুত্বপূর্ণ সময়। ফলে তাঁর জীবনে ইলিশের প্রভাব থাকবে, রসনাস্মৃতিতে ইলিশের গল্প থাকবে, এটা স্বাভাবিক। পূর্ববঙ্গের মানুষ বলেই বুদ্ধদেব বসুর জীবনে এ বঙ্গের প্রকৃতি ও খাদ্যসংস্কৃতির প্রগাঢ় ভূমিকা আছে। আর সে জন্যই তিনি ইলিশকে বলতে পারেন ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ কিংবা ‘রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎসকুলরাজ মহান ইলিশ’। পূর্ববঙ্গের লোক, আরও নিবিড়ভাবে বলতে গেলে বিক্রমপুরের মানুষ হিসেবে তিনি সার্থক চিত্রকল্পই এঁকেছেন ইলিশের।

ইলিশ খেতে হবে, এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ সংস্কৃতির গোড়ার কথা। তবে তার মধ্যেও আভিজাত্য ছিল এবং আছে। শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস ‘স্ক্রিন’ ভাগাভাগি করতে রাজি হলেও, অন্য কিছুর সঙ্গে ইলিশের ‘স্ক্রিন’ ভাগাভাগি করতে বাংলাদেশের মানুষ কখনোই রাজি নয়। আর সে জন্যই ইলিশকে শুধু ‘ইলিশ’ নামেই ডাকা হয়, সঙ্গে মাছ জুড়ে দিয়ে ‘ইলিশ মাছ’ বলার চল এ দেশে প্রায় নেই। পাতেও তাই। ইলিশ খাওয়া হবে তো শুধু ইলিশ, অন্য কিছু তার সঙ্গে অস্পৃশ্য। দময়ন্তী বসু সিং আমাদের জানিয়েছেন, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বুদ্ধদেব বসু ‘ভোজনে বাঙালি’ ছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রান্না চেখে দেখার পরও বুদ্ধদেব তৃপ্ত হতেন ‘চিরাচরিত বাঙালি খাদ্যে।’ খানাখাদ্যে এই বিপুল ‘বাঙালিত্বে’র কারণেই হয়ত ইলিশের ‘পঞ্চপদী’র কথা বুদ্ধদেব বসু ছাড়া কেউ বলেননি।

পঞ্চপদী মূলত বাংলাদেশের ইলিশ সংস্কৃতিরই ভিন্ন ব্যঞ্জনা। মাথা, লেজ, পেটি, তেল এবং ডিমও হতে পারে পঞ্চপদীর এক ধরন। আবার হতে পারে ইলিশের নির্দিষ্ট পাঁচ পদ। পঞ্চপদীর অর্থ দেশের একেক অঞ্চলে একেক রকম। ইলিশ রান্নায় বিক্রমপুরের বিশেষ খ্যাতি আছে। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতির জগতে ‘তারকা খ্যাতি’ পাওয়া একাধিক খাবারের উৎসভূমি বিক্রমপুর। পদ্মার তীরবর্তী এ জনপদ ইলিশ রান্নাতেও অনন্যসাধারণ। বুদ্ধদেব ছিলেন সে অঞ্চলের মানুষ। ফলে তাঁর বলে যাওয়া ইলিশ রান্নায় বিক্রমপুরের স্বাদ পাওয়া যায়।

ইলিশের মুড়ো ও লেজের সঙ্গে লাউ

উপকরণ

ইলিশ মাছের মাথা ও লেজ ছোট করে কাটা, মাথার দুপাশের অংশ হালকা ভেজে রাখা দুই টুকরা, অর্ধেকটা কচি ছোট লাউ তিনকোনা করে কাটা, গরম পানি ১ কাপ, হলুদ পরিমাণমতো, লবণ পরিমাণমতো, কাঁচা মরিচবাটা এক চিমটি, জিরাবাটা আধা চামচ, শর্ষের তেল ১ টেবিল চামচ, কালিজিরা ১ চিমটি, কাঁচা মরিচ দুই ফালি করা।

ইলিশের মুড়ো ও লেজের সঙ্গে লাউ
ছবি: খালেদ সরকার

প্রণালি

কড়াইয়ে শর্ষের তেল দিয়ে কালিজিরা ফোঁড়ন দিয়ে জিরাবাটা, কাঁচা মরিচবাটা, লবণ ও হলুদ দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। এরপর ভেজে রাখা মাথা ও লেজের অংশ ছেড়ে নাড়তে হবে। লাউ দিয়ে দুই মিনিট কষিয়ে এক কাপ গরম পানি দিতে হবে। হালকা আঁচে রেখে লাউ সেদ্ধ হয়ে এলে একটু সবুজাভ রং থাকতে থাকতেই কাঁচা মরিচ দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।

ঝরতি পড়তি কাঁটার মুগডাল

উপকরণ

ইলিশ মাছের মাথা, গলার অংশ, লেজের টুকরা ছোট করে হলুদ–লবণ দিয়ে ভেজে রাখা, মুগডাল ২৫০ গ্রাম (হালকা ভেজে সেদ্ধ করে রাখা, হলুদ আধা চা–চামচ, ধনেগুঁড়া আধা চা–চামচ, তেজপাতা ২-৩টি, জিরাবাটা ১ চা–চামচ, গরম পানি ৩ কাপ পরিমাণ, দারুচিনিগুঁড়া আধা চা–চামচ, শুকনা লালমরিচ তিন–চারটি ফালি করে রাখা, ঘি ৩ টেবিল চামচ।

ঝরতি পড়তি কাঁটার মুগডাল
ছবি: খালেদ সরকার

প্রণালি

কড়াইয়ে ঘি দিয়ে তেজপাতা ও লাল শুকনা মরিচ ফোঁড়ন দিতে হবে। একে একে মরিচের গুঁড়া, লবণ, ধনেগুঁড়া ও জিরাবাটা দিয়ে কষাতে হবে। মাছ ও সেদ্ধ ডাল ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে গরম পানি দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। হয়ে এলে ঘন করে নামাতে হবে। নামানোর আগে ঘি ও দারুচিনিগুঁড়া ছড়িয়ে নামাতে হবে। সবশেষে মরিচ ছড়িয়ে দিতে হবে।

কাঁচা কুমড়াযোগে কালিজিরা ছিটানো পাতলা ঝোল

উপকরণ

ইলিশ মাছের গাদা, পেটি, কাঁচা কুমড়া, কাঁচা মরিচ, কালিজিরা, মরিচ-হলুদবাটা, শর্ষেবাটা, শর্ষের তেল ও লবণ।

কাঁচা কুমড়াযোগে কালিজিরা ছিটানো পাতলা ঝোল
ছবি: খালেদ সরকার

প্রণালি

ইলিশ মাছের গাদা-পেটিতে লবণ ও হলুদ মেখে হালকা করে সাঁতলে রাখতে হবে। কাঁচা মরিচ ও লবণ দিয়ে শর্ষে বেটে রাখতে হবে। এরপর তেল গরম করে তাতে কাঁচা মরিচ ও কালিজিরা ফোঁড়ন দিতে হবে। ভাজা গন্ধ বেরোলে মরিচ ও হলুদবাটা সামান্য পানিতে গুলে ঢেলে নিতে হবে। অল্প কষিয়ে লবণ ও পরিমাণমতো পানি দিতে হবে। পানি ফুটতে শুরু করলে শর্ষেবাটা ও টুকরা করে কাটা কাঁচা কুমড়া দিয়ে ঢেকে রান্না করতে হবে। কুমড়া সেদ্ধ হয়ে এলে ইলিশ মাছ ও কাঁচা শর্ষে তেল দিয়ে ঢেকে অল্প আঁচে কিছুক্ষণ চুলোয় রেখে নামিয়ে নিতে হবে।

কলাপাতায় মোড়া পাতুরি

উপকরণ

বড় ইলিশের টুকরা (গাদা-পেটি একসঙ্গে) চারটি, শর্ষেবাটা (প্রতিটি পাতুরির জন্য) ১ চা–চামচ, কাঁচা মরিচবাটা ১ চা–চামচ, শর্ষে তেল ১ চা–চামচ করে, লবণ পরিমাণমতো, কলাপাতা চারটি বড় টুকরা, মোড়ানোর জন্য সুতা, স্টিমার (না থাকলে স্টিলের টিফিন বক্স)।

কলাপাতায় মোড়া পাতুরি
ছবি: খালেদ সরকার

প্রণালি

প্রতিটি মাছ শর্ষের তেল, শর্ষেবাটা, কাঁচা মরিচবাটা ও লবণ দিয়ে ভালোভাবে মেখে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে সুতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ভাপে দেওয়ার আগে আরও একটু তেল ছড়িয়ে দিতে হবে। স্টিমার অথবা স্টিলের টিফিন বক্সে দিয়ে, হাঁড়িতে পানি চড়িয়ে ৩০ মিনিট ভাপাতে হবে। এরপর গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করতে হবে।

পাতিলেবুর ঠান্ডা অম্বল

উপকরণ

চারটি পাতিলেবুর রস, চিনি ৪ টেবিল চামচ, লবণ সামান্য, কাঁচা মরিচবাটা ১ চিমটি, পানি ৩ কাপ, পাঁচফোঁড়ন ১ চিমটি, ভাটা জিরার গুঁড়া আধা চা–চামচ, ভেজে রাখা ইলিশ মাছের লেজ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রান্না চেখে দেখার পরও বুদ্ধদেব তৃপ্ত হতেন ‘চিরাচরিত বাঙালি খাদ্যে।’ খানাখাদ্যে এই বিপুল ‘বাঙালিত্বে’র কারণেই হয়ত ইলিশের ‘পঞ্চপদী’র কথা বুদ্ধদেব বসু ছাড়া কেউ বলেননি।

প্রণালি

চুলায় প্রথমে কড়াইতে পাঁচফোঁড়ন ছাড়তে হবে। একটু সাতলে নিয়ে তাতে লেবুর রস, চিনি ও পানি ঢালতে হবে। একটু ফুটলে মাছের ভেজে রাখা লেজ ছেড়ে কাঁচা মরিচবাটা ১ চিমটি দিয়ে অল্প আঁচে মিনিট পাঁচেক ফুটতে দিতে হবে। হয়ে এলে ঝোল ঝোল নামিয়ে ঠান্ডা করে শেষে পাতে পরিবেশন করতে হবে।