যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর মার্চ মাসে সাড়ম্বরে মা দিবস পালিত হয়। সময় আর যুগের প্রয়োজনে ভালোবাসা নামক অতি প্রাকৃতিক আবেগকে বাণিজ্যিকীকরণের চটকদার মোড়কে বিকোনোর প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত চতুর ব্যবসায়ীরা। এক দিনের লোকদেখানো পোশাকি ভালোবাসায় ক্লান্ত মায়েদের বেশির ভাগেরই বৃদ্ধ বয়সে শেষ আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রম।
অপ্রিয় হলেও এটাই আজ জীবনের করুণ বাস্তবতা! তবে এই যে চকলেট, ফুল আর কার্ডের মনোহর সাজে ঢাকঢোল পিটিয়ে মা দিবস পালনের ঘটা, তা সৃষ্টির পেছনের চমকপ্রদ ইতিহাস হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। কেমন ছিল সে স্মরণীয় দিনটির পুঞ্জীভূত জমানো বিপ্লব, নিঃস্বার্থ মায়েদের নীরব আত্মত্যাগের অকথিত কাহিনিগুলো। সেসব না হয় আজ শেয়ার করা যাক।
গল্পের শুরু দুটি বিপরীত চরিত্রের নারীর কিছুটা অদ্ভুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। নিঃসন্তান দুই নারীর একজন ছিলেন মধ্যযুগীয় অন্ধ ঐতিহ্যের প্রবল অনুরাগী আর অপরজন চিরাচরিত প্রথা ভাঙায় ঘোর বিশ্বাসী।
‘মাদারস ডে’ অথবা ‘মাদারিং সানডে’—কোন সম্ভাষণে এই দিনকে সম্মান জানানো হবে? হুজুগে মার্কিনরা আসন্ন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে বেছে নিয়েছে। তবে ব্রিটেনবাসী এই দিন ইস্টারের সঙ্গে পালন করে থাকে। সেই হিসাবে এ বছর ছিল ১৪ মার্চ।
যাহোক, ভার্জিনিয়ার অ্যানা জারভিস আসলে আনুষ্ঠানিক মা দিবস পালনের প্রথম উদ্যোক্তা। ১৯০৮ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর তিনি প্রথম দিনটি পালনের ব্যবস্থা করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দিনটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জানান। মার্কিনরা পায় প্রথম মা দিবস পালনের সুযোগ।
চটপটে ব্রিটিশরা সহজে হার মানতে নারাজ, ব্রিটিশ নারী এডিলেড স্মিথ তাঁর মার্কিন সহচরের সাফল্যে অভিভূত হয়েছিলেন। তবে কিছুটা ভিত ছিলেন মার্কিন কৃষ্টির ছায়ায় হয়তোবা ব্রিটিশ আভিজাত্য হারিয়ে যেতে পারে। তাই কৌশলী স্মিথ প্রচারণা শুরু করলেন মধ্যযুগীয় প্রথা পুনরায় প্রবর্তনের।
ইতিহাসবিদ কর্ডেলিয়া সে সময়কার কথা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উপলব্ধি করছে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সহজাত ব্রিটিশ সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মিথ সে সময়কার দ্বন্দ্বমুখর আধুনিকতার উত্থানটি ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। তাই তো সময়ের পালে হাওয়া লাগাতে উৎসাহী হলেন স্মিথ।
সারি সারি চার্চের গগনচুম্বী গম্বুজগুলোকে ‘মাদার চার্চের’ প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল। যদিও মিস স্মিথের বিশ্বাস আর প্রচারণাকে জোরদার করতে এ কার্যক্রম নেহাতই অল্প ছিল। এ বিশ্বাস আর গজিয়ে ওঠা নানা ভ্রান্ত ধারণাকে ঠেকিয়ে রাখতে ১৩ শতকের লিংকনের বিশপ বেশ কিছু শাস্তি প্রবর্তন করেন।
১৭ শতকের দিকে গ্লুস্টারশায়ার আর উরস্টারশায়ারের এলাকাগুলোয় শিক্ষানবিশ আর গৃহকর্মীদের নিত্যদিনের রুটিন ছিল বাড়ি যাওয়া। উদ্দেশ্য একটাই, তাঁদের মায়েদের দেখা। যদিও ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ প্রফেসর রোনাল্ডের মতে, এ সফরগুলো ছিল অবশ্য বাস্তবসম্মত। এ সময় ব্রিটেনের কিছু এলাকার মানুষ যথেষ্ট কঠিন সময় পার করছিল। কারণ, তাদের প্রাপ্য খাদ্যের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট অল্প; জীবনযাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে অনুন্নত। পরিবারের উপার্জনক্ষম তরুণদের দায়িত্ব ছিল তাদের সংগ্রামী মা–বাবাকে দেখভাল করা। আর এ দেখভালের অংশ হিসেবে প্রবর্তন হলো ‘সিমনেল কেক’।
সিমনেল—প্রাচীন এ শব্দের নামকরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলো মা দিবসের উপাদেয় রেসিপির। দিন যায়, সাদামাটা কেকের গায়ে রং চড়তে থাকে। আসে ১৯ শতক। নানা পুষ্টিকর আর স্বাস্থ্যসম্মত উপাদানে স্মারক কেকটি ক্রমে আমজনতার কাছে লোভনীয় হয়ে উঠতে থাকে। সহজ কথায়, আধপেটা খাওয়া অভিভাবকদের উদরপূর্তির সহজ সমাধান ছিল এই রেসিপি। কারণ, এটা মজাদার ও দ্রুত বানানো যায়। সৌন্দর্যের প্রতীক ফুল আর নানা স্মরণীয় ছবি ও লেখায় ভরা বাহারি কার্ডগুলো উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে সংযোজিত হয়।
বিশেষ করে, অ্যানা তাঁর মায়ের পছন্দকে সম্মান জানাতে মাথায় সাদা ফুলের মুকুট পরাকে স্বাগত জানালেন। তবে নতুনত্বে বিশ্বাসী অ্যানা খুব বেশি দিন তাঁর সফলতাকে ধরে রাখতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফুল ব্যবসায়ীদের বয়কটের মুখে পড়েন। কনফেকশনারি আর বেকারিগুলোর কেক তৈরির ওপর অনাস্থাজ্ঞাপন, এমনকি প্রতিবিপ্লবীদের দ্বারা নানা হুমকির আর ভয়ভীতির মোকাবিলা তাঁকে করতে হয়। খোদ অ্যানা ধারণাটির ফাঁপা বাণিজ্যিকীকরণ বুঝতে পেরেছিলেন। মিস জারভিসের মতে, প্রিন্টেড বা ছাপা কার্ড নিতান্ত অলস মস্তিষ্কের ফসল ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে সময়ের সঙ্গে ধ্যানধারণা পাল্টে যাওয়া বেশির ভাগ মানুষ আজ বিশ্বাস করে, সন্তান হারানো মা–বাবা কিংবা যারা তাদের মাকে হারিয়েছে, তারা অন্তত এই দিনকে বিশেষ মনে করতেই পারে। ইতিহাসবিদ কর্ডেলিয়া আরও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অকালে প্রাণ হারানো অসংখ্য স্বজনের চিরতরে মনে রাখতেই দিনটি আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই দিনটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। ১৯৩৮ সাল, চলে গেলেন স্মিথ; তবে বুনে গেলেন তাঁর সাফল্যের বীজটি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আনাচকানাচে আজ ধুমধামের সঙ্গেই পালিত হয় মাদারস ডে।
অন্যপক্ষে, অ্যানার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এমন এক জায়গায় পৌঁছায়, যেটি শেষ পর্যন্ত তার অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি এই দিনকে ছুটির দিন ঘোষণা করতে চাইলেন। মানুষ তাতে সায় দিল না। ফলাফল হলো উল্টো, সাল ১৯৪৩ তিনি মুখোমুখি হলেন সরকারি পিটিশনের, যাতে স্পষ্টভাবে বলা হলো দিনটির অপমৃত্যু ঘটানোর। উচ্চাভিলাষী এই নারীর জীবনের শেষটা হলো বড় করুণ, পাঁচ বছর পর ফিলাডেলফিয়ার মার্শাল স্কয়ার সেনিটারিয়ামে নিঃস্ব অবস্থায় তিনি মারা গেলেন।
মৃত্যু হয়তো শারীরিকভাবে পার্থিব পৃথিবী থেকে তাঁকে সরিয়ে দিল; কিন্তু অগ্রগামী এই নারীর হৃদয়ের শুভ ইচ্ছাটির জয় হলো বীরের মতোই। একদা তাঁর উদ্ভাবনকে অবহেলা করা ফুল ব্যবসায়ী আর কার্ড কোম্পানিগুলো শেষ অবধি তাঁর অপরিশোধিত হাসপাতালের বিলগুলো পরিশোধ করে দিয়েছিল।
মাদারস ডে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। আছে কত সমালোচনাও, তবে সব ছাপিয়ে এতটুকুই আশা, আমাদের আত্মত্যাগী মায়েদের যেন প্রকৃত মূল্যায়ন হয়। ভালো থাকুন সব সময়, পৃথিবীর সব মা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি