ভাষাশিক্ষা, আশাশিক্ষা ১

১.
টাকাপয়সা বেশি নেই হাতে। সস্তায়, কি বিনে পয়সায় রিফিউজিদের জার্মান শেখায়, এমন একটা ইশকুলে ভর্তি হয়েছি। এতগুলো পাস দেবার পর আবার ছাত্র সাজতে মন চায় না। কিন্তু উপায় নেই। জার্মান জানা না থাকলে এ দেশে ডিগ্রি-ফিগ্রির বাজারি দাম খুব কম। যস্মিন দেশে যদাচার পালন করতে ভাষাটা তাই এবেলা শিখতেই হচ্ছে। তা ছাড়া বদমেজাজি কেরানির অকারণ চোখ রাঙানির সামনে একতাড়া ফরম পূরণ করে কাঠখড় কম পোড়াইনি। এখন পিছিয়ে গেলে পুরোটাই পণ্ডশ্রম। অগত্যা দুহাত পকেটে পুরে ধীর পায়ে এগোলাম দমবন্ধ ক্লাসরুম বরাবর।

পাশের জনের সঙ্গে পেন-ফাইট খেলতে থাকা পাংকু চেহারার ছেলেটার পাশের জায়গাটাই শুধু খালি। ছোকরার টি-শার্টের হাতা পাড়ার মাস্তানদের কায়দায় গোটানো। আর কালো লেদার জ্যাকেটজুড়ে চোখা চোখা ধাতব বোতামের ছড়াছড়ি। পাশে বসে এক গুঁতো না খেলেই হয়।

‘কি সিস্টার, খবর ভালো?’ পাংকু বয় চান্স নেবার ভঙ্গিতে চোখ টিপি দিল। পিত্তি জ্বলে গেল একেবারে। জবাবের ধার না ধেরে সে পটাং এক শক্তিশালী টোকায় বলপেনটা ছুড়ে দিল প্রতিপক্ষের দিকে। কী কপাল! কলম গিয়ে ল্যান্ড করল এইমাত্র ক্লাসে আসা ভদ্রমহিলার চার ইঞ্চি হিলের জুতার কাছে। পেনসিল স্কার্ট পরা বছর চল্লিশের ভীষণ স্টাইলিশ ভদ্রমহিলা খপ করে সেটাকে তুলে নিখুঁত নিশানায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে পাঠিয়ে দিল। তারপর মিষ্টি হেসে টেবিলে ডাস্টার ঠুকে জানাল, ‘গুটেন মর্গেন, গুড মর্নিং। আমি এরিকা। এই কোর্সটা আমিই নেব।’

জার্মান ক্লাসের শিক্ষার্থীরা

সরু চোখে তাকালাম। ‘ছাগল পিটিয়ে মানুষ’ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। সেই তো আবার পড়াশোনা। কেন যে ইংরেজি বলা কোনো দেশে না গিয়ে এই জার্মান মুলুকে পড়তে এসেছিলাম। এখন ল্যাও ঠ্যালা। খাও চক-ডাস্টারের বাড়ি।

সাবলীল হাসিটা ধরে রেখে এরিকা বলে চলল, ‘পড়তে বা পড়াতে কোনোটাই আমার ভালো লাগে না। আর জার্মান ভাষাটাও কঠিন। তার চেয়ে আসো গান-টান শুনি। বাই দ্য ওয়ে, নিজেদের ভেতর ‘তুমি’ করে বললে সমস্যা নেই তো?’

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ক্লাসের সবাই নড়েচড়ে বসলাম। এরিকার ছেলেমানুষি কথাবার্তা মজা লাগতে শুরু করেছে। খুঁজেপেতে সে কোত্থেকে কতগুলো সিডি এনে তারই একটা পুরান-ধুরান দেখতে স্টেরিওটাতে চাপিয়ে দিল। গান নয়, বেহালা আর পিয়ানোতে ঝংকার তুলে চমৎকার ক্লাসিক্যাল সুর ভেসে আসছে। বিখ্যাত কারও কম্পোজিশন।

‘কেউ কি বলতে পারবে কার মিউজিক?’
এক বিটোফেন আর দুই মোজার্ট ছাড়া তৃতীয় কারও নাম জানি না। তাই বলে ঝড়ে বক মারার সুযোগ ছাড়ি কী করে। হাত উঁচিয়ে সগর্বে বিটোফেন চালিয়ে দেব ভাবছি। আচমকাই পাশ থেকে পাংকু ছোঁড়া চুইংগাম চিবোতে চিবোতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাখ, বাখ!’।

ক্লাসের সবাই একযোগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। নির্ভুল শটে বক মেরে ছেলেটা একান-ওকান হাসছে। যদিও তার ‘হেভি মেটাল’ লেদার জ্যাকেটের সঙ্গে ‘লাইট ওয়েট’ বাখ-বিটোফেন একেবারেই যায় না। এরিকা সুযোগটা কাজে লাগাল, ‘বিখ্যাত জার্মান কম্পোজার বাখের সুর ধরতে পারা লোক যেনতেন কেউ নয়। ইয়াং ম্যান, আমরা কি তোমার সম্পর্কে জানতে পারি? দু-চার লাইন বললেই চলবে।’

‘চুইংগাম গালেই নিয়েই বলব, নাকি ফেলে দেব?’। প্রশ্নের ধরন শুনে এরিকা দমে না গিয়ে হেসে ফেলল। এ রকম লাফাঙ্গা ছেলে সে গণ্ডাখানেক দেখেছে। তাই সহজ সমাধান বাতলে দিল, ‘গালে রেখেই বলো না।’

ক্লাসের সবার অজান্তে শুরু হয়ে গেল পরিচয়পর্ব।

২.
জামাল ছেলেটা ছয় মাস আগে সিরিয়া থেকে রিফিউজি হিসেবে এসেছে। আপাতত ম্যাকফিট নামের একটা ফিটনেস স্টুডিওতে কাজ নিয়েছে। আকার–ইঙ্গিতে আর ভাঙা ভাঙা জার্মানে কাজ চালিয়ে আসছিল। তবে অল্পে কাজ হবার দিন শেষ। ম্যানেজার হুমকি দিয়েছে, তিন মাসের ভেতর কাস্টমারের সঙ্গে চোস্ত জার্মানে কথাবার্তা চালাতে হবে। নইলে রাস্তা মাপো। রাস্তা মাপামাপি এড়াতে জামাল এই কোর্সে ঢুকেছে। ‘চাকরিটা চলে গেলে বিপদে পড়ব। দেশে সামান্য কটা টাকা পাঠানো শুরু করেছি। তা–ও বন্ধ হয়ে যাবে’, চিন্তিত গলায় শেষ করল জামাল।

শুনে টুনে সামান্য চুপ এরিকা থেকে বলল, ‘হের জামাল, তুমি জায়গামতো এসে পড়েছ। আর চিন্তা নেই। তিন মাসের ভেতর তুমি এমন মারদাঙ্গা জার্মান বলতে শুরু করবে যে ম্যানেজার ব্যাটা ভড়কে যেতে বাধ্য। কথাটা কাগজে লিখে রাখো। সই করে দিচ্ছি।’

এরিকার ডাকাবুকো ভঙ্গি ভালো লেগে গেল। চুইংগাম চিবানো পাংকু জামালকেও আর অত খারাপ লাগছে না। দেশে টাকা পাঠানো লোক খুব খারাপ হতে পারে না।
পরিচয়পর্বের কম্পাস ঘুরে জামালের পেন-ফাইট বন্ধুর কাছে থামল। বয়স বোধ হয় জামালের মতোই পঁচিশ কি ছাব্বিশ। নাম মোস্তফা। তবে ‘মো’ বলে ডাকলেও নাকি চলবে জানাল। নাম ছেঁটে ফুল হাতা থেকে হাফ হাতা করার কেতা সে কই শিখেছে কে জানে। ছেলেটা ইরাক থেকে এসেছে। কুর্দিস্তানে তাদের বাড়িতে উড়ে আসা বোমায় যখন অর্ধেকটা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দাঁড়িয়ে থাকল না, তখন সে সব ছেড়ে জার্মানি চলে এল। কিন্তু কীভাবে এল, একা না সপরিবার—তার কিছুই জানা গেল না। এরিকাও আগ্রহ দেখাল না খুঁচিয়ে জানার।

মিউনিখের যে স্কুলে জার্মান ক্লাস হতো

তবে মোর পাশের মেয়েটাকে নিয়ে সবার ভেতর চাপা আগ্রহ কাজ করছে। রীতিমতো চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছি সবাই। পোর্সেলিনের মতো মসৃণ ত্বক আর একপিঠ ঝলমলে সোনালি চুল নিয়ে মেয়েটা ঘর আলো করে বসে আছে। এতগুলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে সে সামান্য ইতস্তত করে জানাল, তার নাম মিনার্ভা। মনে মনে বললাম, ‘মেয়ে, তোমার নাম আফ্রোদিতি হলেও মানিয়ে যেত’। তা জানা গেল, সে জাতে বলকান। বাড়ি বসনিয়া-হার্জেগোভিনায়। সেই পঁচানব্বইয়ে বসনিয়ার যুদ্ধ শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেছে। চাকরি-বাকরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই দেখে সে দেশ ছেড়ে এসেছে জার্মানির ঠিকানায়।

নানা দেশে থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের কথা শুনতে শুনতে মন অস্থির লাগছে কিছুটা। খবরের কাগজের পাতায় ‘রিফিউজি’ শব্দটায় যত সহজে চোখ বুলিয়ে গেছি, এখন দেখছি এর বাস্তবতা বেজায় কঠিন।

তবে যুদ্ধবিগ্রহই আমার ক্লাসমেটদের একমাত্র সমস্যা নয়। মোটাসোটা সুখী চেহারার পঁয়তাল্লিশ বছরের আমিনার সমস্যা অন্য লেভেলের জটিল। ভাঙা ভাঙা জার্মানে সে জানাল তার পাঁচ সন্তান। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, সবখানেই এক-আধটা ছেলেমেয়ে পড়ছে। বছর বিশেক আগে তুরস্ক থেকে আসা অবধি এ পর্যন্ত ভালোই চলছিল সব। মাসখানেক আগে ছেলেপিলের বাবা দুম্ করে আরেক ঘরে বিয়ে করে তাদের নমস্কার বলে দিয়েছে। এখন সে অথই জলে পড়ে গেছে। তাই ভাষাটা ভালোমতো রপ্ত করে যদি কোনো কিন্ডারগার্টেনে ছোটখাটো চাকরি জোটানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও সাঁতরে তীরে ওঠা যাবে।

বেলারুশের মেয়ে সারার কাহিনিও কাছাকাছি। এত দিন জার্মান শেখার অবসর মেলেনি। ঘরকন্না করে কেটে গেছে দিন। কদিন আগে বেধড়ক মারধর খেয়ে চোখে কালশিটে নিয়ে শিশুসন্তানের হাত ধরে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে সে। এখন নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে আর উপায় নেই। টেবিলে খাতা-কলম সাজাতে সাজাতে অন্যমনস্কভাবে কথাগুলো বলল সারা।

পর্তুগাল থেকে ভাগ্যের খোঁজে আসা বেকার পেদ্রো আর শহরের শেষ প্রান্তে রিফিউজি ক্যাম্পের টিনের কনটেইনারে গাদাগাদি করে থাকা আফগান মেয়ে লিলির গল্প দিয়ে শেষ হলো বিচিত্র এক পরিচয়পর্ব।

মন দিয়ে সবার কথা শুনছিলাম। সত্যি বলতে কি, একসঙ্গে এতগুলো ভাঙাচোরা মানুষকে আগে কখনো দেখেনি। ক্লাসরুমের পিনপতন নীরবতা বড্ড কানে বাজতে লাগল। (চলবে)

লেখক: পোস্ট ডক্টরাল গবেষক: ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি

ছবি: লেখক