বহুরূপী নাকফুলদের কথা

‘হলুদ বনে বনে, নাক-ছাবিটি হারিয়ে গেছে সুখ নেইকো মনে’

বনবাদাড়ে অপুর জন্য সাদা গন্ধভাদালপাতা খুঁজতে গিয়ে দুর্গার স্বগোতক্তির ছড়াটি যেন বাংলার নারীদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে আটকে থাকা নাকছাবির কথা বলে। অথবা কবি আল মাহমুদের কবিতায় ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে, হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে’ পড়তে গিয়ে আমাদের মনের কোণে উঁকি দেয় হারিয়ে ফেলার শূন্যতা। সজ্জায় নারীর বিশেষ বিশেষ গয়নার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নাকের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নাকফুলসহ নানা গয়নার চল আবহমানকালের। এসব গয়নায় কেবল নাকের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, মুখাবয়বে আনে অন্য মাত্রা।

নাকফুলের নকশায় দেখা যাচ্ছে নতুনত্ব
মডেল: আজরা, নাকফুল: হাটবাজার, সাজ: কিউবেলা, ছবি: কবির হোসেন

প্রথা আর বিদ্রোহের প্রতীক নাকের গয়না

নাকে ছিদ্র করে পরার গয়নার চল কীভাবে কোথায় শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ চলে ইতিহাসবিদদের মধ্যে। পুরাকীর্তির নিদর্শন অনুযায়ী, সেই আদিকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে নাকে গয়না পরে আসছেন নারীরা। আবার একদল বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকেই মুসলিম সংস্কৃতির হাত ধরে বিবাহিত মেয়েদের নাকফুল পরার রীতি এসেছে এখানে।

নাকফুল কখনো আবেদন আর আভিজাত্যের প্রতীক, আবার কখনোবা বিদ্রোহের
ছবি: পেকজেলসডটকম

নাকফুল কখনো আবেদন আর আভিজাত্যের প্রতীক, আবার কখনোবা বিদ্রোহেরএদিকে নেটিভ আমেরিকান, পূর্ব আফ্রিকান এবং দুনিয়াজুড়ে বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা নাকে বিচিত্র সব অলংকার পরে থাকেন। দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধি হলে বা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময়ে নাকে ঘটা করে গয়না পরানোর চল আছে বহু জায়গায়। বাঁ নাকের প্রেশার পয়েন্টে ফুটো করলে তা সন্তান জন্মদানে সহায়ক হতে পারে, এমন বিশ্বাস থেকেও অনেক দেশে এই প্রথা প্রচলিত।

নাকফুলের রকমফের
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

মধ্যপ্রাচ্য ও আমাদের উপমহাদেশে এই নাকের অলংকারের সঙ্গে প্রথাগতভাবে বিবাহিত নারীর প্রতীকী উপস্থাপন, স্বামীর মঙ্গলকামনা এবং সেই সঙ্গে রূপ-শৃঙ্গারেরও যোগসাজশ আছে। তবে আজকাল আর এসব নিয়ে এতটা ধরাবাঁধা নিয়ম মানে না অনেকেই। বিবাহিত, অবিবাহিত অনেকেই নাকে গয়না পরেন নিজের সৌন্দর্যকে আরও উদ্ভাসিত করতে। আমাদের সমাজে যেখানে নাকের গয়না সংস্কৃতি, নববধূর সাজ—এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, অন্যদিকে পশ্চিমা সমাজে নাকে ফুটো করে বিচিত্র সব গয়না পরা অনেকটা প্রথা ভাঙা আর বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।  

বিবাহিত, অবিবাহিত অনেকেই নাকে গয়না পরেন নিজের সৌন্দর্যকে আরও উদ্ভাসিত করতে
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

নাকফুলের কথা

নাকের গয়নার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আর সর্বজনীন হচ্ছে নাকফুল। নামে নাকফুল হলেও আসলে এর আকার–আকৃতি ছোট বৃত্তাকৃতি, চারদিকে ধাতব সেটিংয়ে পাথর বসানো, লবঙ্গ আকৃতি এমনকি ত্রিকোণাকৃতিও হতে পারে। কিশোয়ার চৌধুরীর বাঁ নাকে হিরের যে ছোট নাকফুলটি সবার নজর কেড়েছে, এ রকম বিভিন্ন সাইজ ও কাটের হিরে এবং হিরে সদৃশ জারকন বা আমেরিকান ডায়মন্ড দিয়েও ঝিকমিকে নাকফুল বা নোজ পিন সবারই পছন্দের শীর্ষে।  একে ‘নোজ স্টাড’ও বলা হয়। নাকফুল সাধারণত বাঁ নাকে পরা হলেও ভারতের অনেক জায়গায়, যেমন দক্ষিণ ভারতে ডান নাক, এমনকি দুই নাকেও পরে থাকে। একসময় দক্ষিণের কিংবদন্তি গায়িকা মিস সুব্বুলক্ষ্মীর দুই নাকে পরা ট্র্যাডিশনাল মুকুথি সবার মন জয় করেছিল। ভারতীয় অভিনেত্রী রেখার বাঁ নাকে পরা নাকফুল ‘উমরাওজান’ ছবিতে তাঁকে অনন্য এক অভিজাত লুক দিয়েছিল।

নানা ডিজাইনের নথ এখন দারুণ জনপ্রিয়
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

নাকছাবির রকমফের

আবহমানকাল ধরে গ্রামবাংলায় নাকছাবির খুব কদর ছিল।  একটু বড় এই নাসিকালংকার সাধারণত হুপ বা আংটাযুক্ত হয়। এতে মিনাকারীর কাজ দেখা যায়। খাঁটি সোনার এই নাকছাবি বিবাহিত নারীর গৃহকোণ আলো করা, মাতৃত্বকে সগর্বে ধারণ করার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। তবে এখনকার দিনে এই নাকছাবিরই একেবারে আধুনিক রূপ সোনা, রুপা বা অক্সিডাইজড ধাতুতে গড়ানো হয় অগুনতি ডিজাইনে। মান্ডালা, আলপনা বা সূর্যের ডিজাইনে বড় নাকছাবিকে নাকপাশাও বলা হয়। নাকছাবির আধুনিক ফ্যাশনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।

নাকফুল পরতে ভালোবাসেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ট্রেডিশনাল সাজে আভিজাত্য আর আবেদনের প্রতীক নথ

ভারতে মারাঠি সংস্কৃতিতে নথ বা উত্তর ভারতের নথনি বা লটকন সে অঞ্চলের নারীর অলংকরণে এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বড় আকৃতির কাজুবাদাম আকারের বা গোল রিংয়ের এক প্রান্তে মণি–মুক্তা বা সোনার সূক্ষ্ম নকশায় এই নথ ট্রেডিশনাল সাজপোশাকের সঙ্গে আভিজাত্যের পাশাপাশি অত্যন্ত আকর্ষণীয় লুক এনে দেয়। বিয়ের কনের জন্য সোনার তৈরি নথগুলোতে বেশ ডিটেইলিংসহকারে কারুকার্য করা হয়ে থাকে। আংটা দিয়ে আটকানো হয় ভারী ডিজাইনের এই নথ।

মারাঠি বিয়েতে কনের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ নথ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

কম যায় না টানা নথও

আমাদের উপমহাদেশে কনের সাজে যুগ যুগ ধরে টানা নথের এক অন্য রকম আবেদন রয়েছে। ভার সামলাতে এর সঙ্গে চেইন বা বাসরাই মুক্তার পাতলা মালা টেনে চুলের সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়। আগে রানিরা অনেকেই সব সময় এই নথ পরে থাকতেন। গ্রামবাংলায় একে ঢেঁড়ি নথও বলা হয়। এখন তো এই টানা নথের আধুনিক রূপ আমরা অহরহ ফ্যাশন র‍্যাম্পে দেখি। আমাদের দেশে জনপ্রিয় ব্যান্ড চিরকুটে প্রধান ভোকালিস্ট সুমীর আইকনিক টানা নথের লুক খুবই সমাদৃত সবার কাছে।  

শারমিন সুলতানা সুমির নথ দারুণ সমাদৃত সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে
ছবি: ফেসবুক

মন আটকে যায় নোলকে

নোলক অন্যান্য নাসিকালংকার থেকে একেবারেই আলাদা। কারণ, গয়নাটি নাকের ডাঁটি বা সেপ্ট্রামে ছিদ্র করে পরা হয়।  গ্রামবাংলার নববধূর জলকে চলার দৃশ্য, তার মায়াভরা মুখ, সঙ্গে ঠোঁটের ঠিক ওপরে ঝুলে থাকা সোনার ছোট্ট নোলকটি মন কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাধারণত রিং বা লুপ আকৃতির নোলকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সোনার গোলাকার বুন্দি বা ছোট্ট ঝালর বা ঝুমকা। আবার অনেক সময় হুপ শেপের বা টপ সিস্টেমের আটকে থাকা গয়নাও পরা হয় নাকের দাঁড়ায়। জনপ্রিয় পশ্চিমা গায়িকা রিহানার সেপট্রাম স্টাড বা রিংয়ের অন্য রকম লুক তাঁকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক স্টাইল বিশেষজ্ঞরা।

সেপট্রাম স্টাডেআবেদনময়ী রিহানা
ছবি:” ইনস্টাগ্রাম