আশি লাখ টিউলিপের সাম্রাজ্যে
যত দূর চোখ যায় কেবল টিউলিপ আর টিউলিপ। যেন সবুজ প্রান্তরে ফুলেল রংধনু বিছিয়ে সবটুকু সৌন্দর্য মেলে ধরেছে প্রকৃতি। মিষ্টি রোদে হাজারো মানুষের সঙ্গে নীলাম্বরও তার সাদা মেঘের দল নিয়ে এসেছে এই বর্ণাঢ্য টিউলিপ দেখতে। জায়গায় জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে রংবেরঙের বাইসাইকেল। রয়েছে কাঠে বানানো বড় আকৃতির টিউলিপ এবং নানান রঙের প্রজাপতি। এগুলো মূলত নানা ঢঙে ছবি তোলার ফ্রেম। যেখানে যেভাবেই ছবি তোলা হোক না কেন, অপূর্ব। দেখে মনে হয় নব্বই দশকের বলিউডের সিনেমার গানের দৃশ্য। বলছি হল্যান্ড রিডজ ফার্মের কথা। মধ্য নিউ জার্সিতে ৯০০ বিঘা জায়গা নিয়ে হল্যান্ডের অধিবাসীরা গড়ে তুলেছেন এই টিউলিপ-সাম্রাজ্য। এবার তাঁরা আবাদ করেছেন ৮০ লাখ টিউলিপ ফুল।
এই বিস্তৃত অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখাতে ট্রাক্টরের পেছনে কাঠের বগি যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ শাটল। শত মানুষ নিয়ে সবুজ শাটলটি ধীরগতিতে এগিয়ে চলে টিউলিপখেতের পাশ ঘেঁষে। দর্শনার্থীদের জন্য বিনা খরচে চলা এ শাটলের আছে বেশ কয়েকটি স্টেশন। আছে শৌচাগারের ব্যবস্থা আর অজস্র খাবারের দোকান। ছোট একটি মিউজিয়াম আছে। তাতে দেখা যায় টিউলিপ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা নানান সরঞ্জামাদি। আছে টিউলিপের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের বর্ণনা। ছোট একটি চিড়িয়াখানাও আছে। সেখানে আছে ঘোড়া-ভেড়া ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু। শিশুদের জন্য আছে ঘোড়া ও ঘোড়াশাবকের পিঠে চড়ার ব্যবস্থা।
যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ ও লেখক আশরাফুন নাহারের সঙ্গে ফার্মে দেখা। বেড়াতে এসেছেন? জানতে চাইলেই বললেন, ‘পরিবার, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছি। প্রতিবছর এই সময়ে আমরা এখানে আসি। বিশাল জায়গাজুড়ে একসঙ্গে নানা রঙের বিপুল টিউলিপ দেখে মন জুড়িয়ে যায়। হৃদয় প্রসারিত হয়। যেদিকে চোখ যায় দিগন্তবিস্তৃত কেবল টিউলিপ। এসব দেখে আমি আবার সৃজনশীল কাজের ধারাবাহিকতায় ফিরি। নতুন উদ্যমে শুরু করি লেখালিখি।’
খামারের পাশেই আছে ডাচ ঐতিহ্যে নির্মিত টিউলিপচাষিদের বাড়ি। বাড়ির সামনে পরিচ্ছন্ন উন্মুক্ত উঠান। চেরি ফুলসহ নানান ফুল-ফলের বড় বড় গাছের নিচেও লাগানো হয়েছে এক-দেড় ফুট উচ্চতার সব টিউলিপগাছ। ভাস্কর্য করে রাখা হয়েছে টিউলিপ চাষে ব্যবহৃত তাদের পূর্বপুরুষের কাঠের হলুদ জুতা। হলুদ জুতা পায়ে দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থাও আছে। মাঠ থেকে ফুল তুলে এনে দিলে তারা সুন্দর করে প্যাকেট করে দেয়। তার জন্য ফুলপ্রতি গুনতে হয় এক ডলার। অনলাইনে অর্ডার করলে আছে ডেলিভারির ব্যবস্থা। খামারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ডাচ বংশোদ্ভূত। তাঁদের আচরণ অমায়িক।
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস থেকে ফার্মটির দূরত্ব ৭০ মাইল। গাড়িতে করে যেতে লাগে দেড় ঘণ্টা। বাগানে প্রবেশের আগে হাজার দুয়েক গাড়ি পার্কিংয়ের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা আছে। তেরো ডলারে টিকিট কেটে বাগানে প্রবেশের সময় এক পাতার একটি ব্রুসিয়ার ধরিয়ে দিয়েছে হাতে। তাতে লেখা, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় টিউলিপ ফার্ম। দেওয়া আছে ফার্মের যাবতীয় দিকনির্দেশনা। ফার্মটি দর্শনার্থীদের জন্য সকাল ৯টায় খোলে, বন্ধ হয় বিকেল ৫টায়।
লাল, নীল, সাদা, হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, কমলা—প্রকৃতির সব রং যেন টিউলিপ ফুলে আছে। এক রঙের টিউলিপেও আছে নানান ধরন। তাই এটি একাই একটি রঙের উৎসব। এ সপ্তাহে টিউলিপ ফুটতে শুরু করেছে। সপ্তাহ পাঁচেকের স্বল্প জীবন নিয়ে এ ফুল বর্ণময় করে তোলে পুরো প্রকৃতি। তাই আমেরিকাজুড়ে এখন টিউলিপ উৎসব। ভিন্ন বর্ণের টিউলিপ উপহার দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে।
পশ্চিমা জনজীবনে আনন্দ-বেদনা সব উপলক্ষে টিউলিপ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুবাসহীন এ ফুল পৃথিবীব্যাপী এত জনপ্রিয় হবে, তা আর কেউ না জানলেও জানতেন অটোমান সুলতানরা। ষোড়শ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান তাঁর শাসনামলে মনোরঞ্জনের জন্য টিউলিপ চাষাবাদ বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তুরস্কে ১৮ শতাব্দীর প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল ‘টিউলিপ যুগ’। এই অঞ্চলে টিউলিপের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ আফগানিস্তানের জাতীয় ফুল টিউলিপ। ইতিহাসবেত্তারা ধারণা করেন, অটোমান সাম্রাজ্য পেরিয়ে ইউরোপে এই ফুল প্রবেশ করে ভিয়েনার একজন জীববিজ্ঞানীর মাধ্যমে। মধ্য এশিয়ায় জন্ম নেওয়া এ ফুলকে আপন করে নেয় ইউরোপের দেশ হল্যান্ড। দান করে জাতীয় ফুলের মর্যাদা। হল্যান্ডের নতুন নাম নেদারল্যান্ডস। এটিই এখন বিশ্বের বুকে সর্বাধিক টিউলিপ উৎপাদন ও রপ্তানিকারী দেশ।