ঈশ্বরীর ইন্দারা

গত সপ্তাহে দেখতে গিয়েছিলাম ঈশ্বরীর ইন্দারা। তবে এটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের তৈরি করা কোনো কুয়া নয়। ইব্রাহিম নবীর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা বিবির তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ঈশ্বরের কুদরতে সৃষ্ট কুয়াও এটা নয়। তিউনিসিয়া বিজয়ী মুসলমান সৈন্যদের পানি সরবরাহের জন্য কেরওয়ান শহরের সাইদি উকবার গায়েবি কুয়াও এটা নয়। আমি দেখতে গিয়েছিলাম বেনারসের মহারাজা ঈশ্বরী প্রসাদ নারায়ণ সিংহের দানে খনন করা, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরের কাছে স্টোক রো গ্রামের একটি দৃষ্টিনন্দন কুয়া।

বেনারসের মহারাজা ঈশ্বরী প্রসাদ নারায়ণ সিংহের দানে খনন করা, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরের কাছে স্টোক রো গ্রামের কুয়া
ছবি: লেখক

১৮৬৩ সালে বেনারস ছিল ইংরেজ রাজত্বের অধীনে একটি দেশীয় রাজ্য। যুক্ত প্রদেশের গভর্নর এডওয়ার্ড রিডি একদিন কথায় কথায় মহারাজাকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলের খাওয়ার পানির সমস্যার কথা বললেন। ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করে সাহেব জানালেন তাঁর বাড়ির পাশে চিলটার্ন পাহাড়ের ঢালে স্টোক রো গ্রামে খরার সময় খাওয়ার পানির খুব অভাব হয়। এক মাইল দূর থেকে হেটে কাঁধে ব্যাগ চড়িয়ে পানি আনতে মানুষের খুব কষ্ট হয়।

শৈশবের স্মৃতিচারণা করে রিডি সাহেব আরও বললেন, ‘একদিন আমি ওই গ্রামের পথে হাঁটছিলাম, দেখলাম একটা ছোট ছেলেকে তার মা লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে পেটাচ্ছে। আমাকে দেখে ছেলেটা দৌড়ে এসে আমার পেছনে আশ্রয় নিল। তার মা বলল, “এই শয়তান ছেলেটা ঘরের সবটুকু খাওয়ার পানি খেয়ে ফেলেছে। এখন আমরা পানি পাব কোথায়? তুমি যদি ছেলেটাকে রক্ষা করতে চাও তাহলে আমি তোমাকেও পেটাব।”’

মহারাজার দয়া হলো। তিনি টাকা দিলেন। রিডি সাহেব ব্যবস্থা করলেন। স্টোক রোতে কুয়া খনন করা হলো। গ্রামে পানির অভাব মিটে গেল। কৃতজ্ঞ গ্রামবাসী আদর করে এর নাম দিল ‘মহারাজার কুয়া’, ইংরেজিতে ‘মহারাজাস ওয়েল’। কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

সড়কে সাইনবোর্ড ‘স্টোক রো—মহারাজাস ওয়েল’
ছবি: লেখক

বার্মিংহাম শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলাম। প্রথমেই মুশকিলে পড়লাম এম–৫ মোটরওয়ের ট্রাফিক জ্যামে। ঘণ্টাখানেক বাদে জ্যাম ছাড়ল, আমরা ছুটলাম। এম–৪০ ধরে জংশন ৬ পর্যন্ত। তারপর বি–৪০০৯ ধরে ওয়াটলিংটন। বি–৪৮০ এবং বি-৪৮১ ধরে কুকলি গ্রিন এবং নেটেলবেড নামের গ্রাম দুটি পার হয়ে পৌঁছে গেলাম ক্রস নামের এক জায়গার রাস্তার তেমাথায়—দেখলাম সাইন পোস্ট। বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘স্টোক রো—মহারাজাস ওয়েল’। মনের মধ্যে শিহরণ খেলে গেল। সাইন পোস্টের দিকের নির্দেশমতো ডানে মোড় নিলাম। দুই পাশে বড় বড় পাহাড়ি গাছের মাঝে সরু রাস্তায় চলে ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

ঘুমন্তপ্রায় ছোট্ট একটা গ্রাম। গাড়িতে বসেই হাতের ডানে ‘মহারাজার কুয়া’ দেখা গেল, বাঁয়ে ‘বেনারস গ্রোভ’ নামের রাস্তা। গাড়ি পার্ক করে নামলাম। হেঁটে হেঁটে ঘুরলাম।

দেখলাম, কুয়া-মাথার চারদিকে ইটের দেয়ালের ওপরে কংক্রিটের বেদি। তার ওপরে দাঁড়ানো আটটি লোহার খাম্বা ধারণ করে আছে একটি গম্বুজ। আফগান-মোগল স্থাপত্যের অনুকরণে লোহার গম্বুজ নির্মাণের প্রচেষ্টায় ইংরেজ কর্মকারদের একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ব্যাস ও উচ্চতার যথার্থ অনুপাত থাকায় পুরো কাঠামোটা দেখতে খুব সুন্দর। গাঢ় ও হালকা খয়েরির সঙ্গে সোনালি আর নীল রঙের বর্ডার এবং গম্বুজের সোনালি চূড়া এটাকে আরও সুন্দর করেছে।

বেনারস গ্রোভ’ নামের রাস্তা
ছবি: লেখক

ভেতরে একটা সোনালি হাতি আর বাইরে নীল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপরে সাদা অক্ষরে লেখা ‘হিজ হাইনেস দ্য মহারাজা অব বেনারস’। এ কুয়াটির সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্কের কথা নিশ্চিত করেছে।

বাংলা আটচালা স্টাইলে নির্মিত কুয়া রক্ষকের থাকার ছোট্ট ঘরখানাও দেখতে চমকপ্রদ। পাশেই মোগল বাদশাহদের চার-বাগ রীতিতে ল্যান্ডস্কেপ করা মাঝারি আয়তনের পার্কের মধ্যে ছোট টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি একটি হাতি। শোনা গেছে, মহারাজা ঈশ্বরী প্রসাদ নাকি সব সময় হাতিতে চড়ে চলাচল করতেন, তাঁর সম্মানেই এখানে এমন কৃত্রিম হাতির সমারহ। শৈল্পিক সৌন্দর্য যতই হোক, এই বরফ পড়া ঠান্ডার দেশে উন্মুক্ত মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা হাতিটার জন্য আমার করুণা হলো।

চার একর জমি কেনা এবং পার্ক তৈরি করার সব খরচ মহারাজা বহন করেন, এখানে তিনি চেরি ফলের বাগান করেছিলেন। চেরি বিক্রির পয়সা দিয়ে কুয়া রক্ষকের বেতন দেওয়া হতো। এখনো কিছু চেরিগাছ আছে বটে, তবে তা ফল নয় ফুলের জন্য। ছেঁটে রাখা প্রিভেটগাছের বর্ডার আর সবুজ ঘাসের উন্মুক্ত মাঠ মহারাজার কুয়ার শোভা বর্ধন করছে।

প্রিভেটগাছের বর্ডার আর সবুজ ঘাসের উন্মুক্ত মাঠ মহারাজার কুয়ার শোভা বর্ধন করছে
ছবি: লেখক

কুয়ার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গ্রামের বড় রাস্তার ফুটপাতটা মহারাজার টাকায় করা। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ গ্রামের যে রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেনারস গ্রোভ’ সেখানেই আমি গাড়ি পার্ক করেছি। ১৮৬৩ সালের মার্চ মাসে শুরু করে ৪ ফুট ব্যাস এবং ৩৬৭ ফুট গভীর কূপটি খনন করতে সময় লাগে ১৪ মাস। খরচ হয় ৩৫৩ পাউন্ড। কুয়ার ওপরের গম্বুজ করতে খরচ হয় ৩৯ পাউন্ড। কুয়ারক্ষকের ঘর বানাতে খরচ হয় ৭৪ পাউন্ড। ৪ একর জমি কিনে পার্ক বানাতে কত খরচ হয়েছিল, তা জানতে পারিনি। তবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অক্সফোর্ডে ৪ একর জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। ১৫৭ বছর আগে খরচ করা টাকার বর্তমান মূল্য কত, তা হিসাব করা অসাধ্য ব্যাপার। তবে মহারাজা ঈশ্বরী প্রসাদ যে অনেক টাকা খরচ করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এখন অক্সফোর্ড শহরের ‘অক্সফ্যাম’ আমাদের দেশে আর্সেনিকমুক্ত খাওয়ার পানির একটা কুয়া খুঁড়তে ২০০ পাউন্ড দান করে কত প্রচারণা চালায়। আর বিদেশি সাহায্য আনতে পারার কৃতিত্বে আমাদের ছোট আর বড় নেতারা কত না গর্ব অনুভব করেন। অথচ মাত্র ১৫০ বছরের পুরানো ইতিহাসটা কত আলাদা, তখন আমাদের টাকায় ইংল্যান্ডে খাওয়ার পানির কুয়া খোঁড়া হতো।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শুধু আমাদের আর্থসামর্থ্যই দুর্বল করেনি, আমাদের মেরুদণ্ডও ভেঙে দিয়েছে।

মহারাজা ঈশ্বরী প্রসাদের সম্মানে তৈরি করা হাতির সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

গ্রামের এক পাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত ঘুরে দেখলাম। বুঝতে পারলাম ‘মহারাজার কুয়া’ই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। করোনাভাইরাসের জন্য মানুষের চলাচলে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ছোট–বড়, নারী–পুরুষ, কালো–সাদা, দেশি–বিদেশি মিলিয়ে ২০–৩০ জন মানুষের সমাগম দেখলাম সেখানে।

৭০ বছর বয়সেই মহারাজার কুয়া রিটায়ারমেন্টে চলে গেছে। ১৯২৭ সালে গ্রামে পানির লাইন আসার পর থেকেই কুয়ার ব্যবহার কমতে থাকে। অবশেষে ১৯৩৪ সালে কুয়াটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আমি কুয়ার পানি পান করতে পারলাম না। রাস্তার অপর পাশে ক্যাফেতে স্যান্ডউইচ এবং কফি খেতে খেতে পাশে বসা অন্য গ্রাহকদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, তারা সবাই আমাদের মতো মহারাজার কুয়া দেখতে এসেছে। একদলের বাচনভঙ্গিতে বোঝা গেল তারা আমেরিকান। আমি গর্বিত হলাম। কারণ, ইংল্যান্ডের বন-পাহাড়ের এই ক্ষুদ্র গ্রামটা একজন ভারতীয় নাগরিকের সৌজন্যে বিশ্বমানচিত্রে স্থান পেয়েছে।

তবু ১৮৬৪ সালে অক্সফোর্ডের গণ্যমান্যদের সবাই কুয়ার ব্যাপারে খুশি হতে পারেননি। অসহায় মানুষের কষ্ট কমলে যাঁদের কষ্ট বাড়ে তাঁরা বলেছিলেন, ‘এই ছোট্ট গ্রামের অল্পসংখ্যক মানুষের সাহায্য করতে আনুপাতিকভাবে খুব বেশি পরিমাণ টাকা খরচ করা হয়েছে।’ বর্তমান ভারতে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে যাঁদের চোখ টাটায় তাঁদের পূর্বসূরি ইংরেজ প্রভুদের কেউ বলেছিলেন, ‘কুয়ার ওপর নির্মিত ভারতীয় স্থপতি ধারার গম্বুজ এবং পাশের আটচালা ঘরখানা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং দৃষ্টিকটু।’

সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, লুণ্ঠন আর নির্যাতনের ঘটনাগুলো কেটে বাদ দিয়ে, ইংরেজদের গৌরবগাথা লেখায় নিবেদিতপ্রাণ ঐতিহাসিক নামে পরিচয় দেওয়া কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় অকৃতজ্ঞ এবং বর্বর ভারতীয় সৈন্যরা নিরপরাধ ইংরেজ মহিলা এবং শিশুদের কানপুরের একটি কুয়ার মধ্যে ফেলে হত্যা করেছিল, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতীয়দের পক্ষ হয়ে ইংরেজদের ক্ষমা ভিক্ষা করার জন্য মহারাজা এই কুয়া তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা তার মহত্ত্বের নয়, আনুগত্যের প্রতীক।’

১৯২৭ সালে স্টোক রো গ্রামে পানির লাইন আসার পর থেকে কুয়ার ব্যবহার কমতে থাকে। ১৯৩৪ সালে কুয়াটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়
ছবি: লেখক

ওপরের মন্তব্যগুলো ঐতিহাসিক সত্য নয়, অকৃতজ্ঞতার প্রকাশ। সৌভাগ্য আমাদের, ‘অজ্ঞ মানুষের অকৃতজ্ঞতা মহৎ মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।’

বেনারসকে বাঙালিরা কাশী বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার ‘শত সখীসনে স্নানে চলা কাশীর মহিষী করুণা’র সঙ্গে মহারাজার কী সম্পর্ক ছিল, তা আমি জানি না। তবে আমি জানি, ১৮৮২ সালে রানি ভিক্টোরিয়াকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হলে উৎসব করার জন্য মহারাজা স্টোক রো গ্রামের সবাইকে বিনা মূল্যে দুপুরের খাবার পরিবেশন করেছিলেন। গ্রামবাসী তৃপ্ত হয়েছিল।

মহারাজা ঈশ্বরীবাবুর কীর্তি দেখে আমিও তৃপ্ত হয়েছি।