দাঁড়িয়ে আছি ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে, ইমিগ্রেশনের ঝক্কি ঝামেলা শেষ করে বাক্সপেটরা নিতে। ব্যাগেজ ক্যারোজেলটি ঘুরছে। বেশ ঘুরছে। ডান হাত দিয়ে ধরে আছি কেবিন লাগেজ। আমার গলা থেকে পেট অবধি নেমে গেছে ছোট আরেকটি ব্যাগ, যেটাতে কেবল পাসপোর্ট আর সামান্য কিছু ইউরো। ব্যাগেজ ক্যারোজেলটি ঘুরছে তো ঘুরছেই। যে যার যার লাগেজ সংগ্রহে ব্যস্ত। আমি সতর্ক। এই তো পেয়ে যাব আমার ব্যাগ দুইটা—একটা টকটকে লাল, অন্যটা খয়েরি মতো।
ব্যাগ আর আসে না। আমার শঙ্কা বাড়ছে। খানিকটা বিরক্ত, বেশ ক্লান্ত। ব্যাগেজ ক্যারোজেলটিতে আর একটি ব্যাগও অবশিষ্ট নেই। সে থামল। বুঝলাম আমার ব্যাগ আসেনি। একে তো সন্তান, পরিজন ছেড়ে দূর দেশে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসাতে মনের ভেতরে যে গোপন কষ্ট, তাতে আরও খানিকটা নতুন কিছু যুক্ত হলো। এয়ারপোর্টে অভিযোগ করে তার রসিদ নিয়ে এক্সিট গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম, গন্তব্য বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প শহর।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম দুই সপ্তাহ থাকার ব্যবস্থা হয়েছে একটি সাদামাটা স্টুডেন্ট হোস্টেলে। আমি পরে আছি ফতুয়া আর জিনস। কেবিন লাগেজে আর একটি কামিজ পাওয়া গেল। একটি জামা আমি রাতে পরি, একটি দিনে। পরার মতো আর কোনো পোশাক নেই; লাগেজ কবে পাব সে ধারণাও নেই। আগস্ট মাসের শেষ কিন্তু শীত আসার তেমন লক্ষণও নেই এখানে। বেশ গরম পড়ছে। এসির সিস্টেম তো এদের তিন কূলে থাকার কথা না। একটা টেবিল ফ্যান পেলে বেশ হতো।
পাঁচ দিন এভাবে কাটল। শুক্রবার এল। ঠিক করলাম ব্রাসেলস যাব। সাপ্তাহান্তিক অবকাশ বলে কথা! মনস্থির করলাম ট্রেনে যাব। অ্যান্টওয়ার্প সেন্ট্রাল রেলস্টেশনে এসেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ব্রাসেলস যাওয়ার জন্য ১১ ইউরোর টিকিট কিনলাম কিনা মাত্র ৪ ইউরো দিয়ে। এখানে নাকি এমনটাই নিয়ম। শুক্রবার টিকিট কাটলে আর সেই টিকিটে শনি-রোববারের মধ্যে ভ্রমণ করলে ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে ট্রেনের টিকিট মেলে।
গ্র্যান্ড প্লেসকে বলা হয় ব্রাসেলসের প্রাণকেন্দ্র। সর্বক্ষণ ঠাসাঠাসি পর্যটকে। সরকারি ছুটির দিন বলে আরও একটু বেশি ভিড় মনে হলো। পর্যটকদের কাছে এখানকার প্রধান আকর্ষণ মানিকেন পিস। মানিকেন মূলত একটি নগ্ন শিশুভাস্কর্য, বিরতিহীনভাবে মূত্রত্যাগ করেই যাচ্ছে। গ্র্যান্ড প্লেস থেকে হাঁটতে থাকি।
জনস্রোত যেদিকে যাচ্ছে, আমিও সেদিকে যাচ্ছি। গ্র্যান্ড প্লেস থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেকের হাঁটার দূরত্ব। রাস্তাটি খুব প্রশস্ত নয়। রাস্তার দুধারে ঠাসাঠাসি স্যুভেনিরের দোকান। প্রতি দোকানের সামনেই সাজানো ছোট, মাঝারি, বড়, নানান রঙের, নানান ঢঙের মানিকেনের স্যুভেনির। দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা মানিকেনের সেসব স্যুভেনিরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছবি তোলার লোভ সামলানো মুশকিল ছিল আমার জন্য।
হুম, দেখা মিলল কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেলজিকদের অন্যতম প্রধান প্রতীকটির সঙ্গে। মাত্র ৬১ সেন্টিমিটারের (২৪ ইঞ্চি) ব্রোঞ্জের ঝরনা ভাস্কর্য। সবকিছুতেই আমার গুগলের কাছে যেতেই হয়, এখানেও তা-ই হলো। মোবাইল বের করে জানার চেষ্টা করছিলাম ঠিক কবে এটি স্থাপিত হয়।
গুগল জানাল, ১৬১৮ কিংবা ১৬১৯ সালের দিকে। রাস্তার ওপর আমার আশপাশে আরও জনা বিশেক পর্যটক দাঁড়িয়ে। এর চেয়ে বেশি মানুষ একই সময়ে একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে মানিকেনকে দেখার পক্ষে যথেষ্ট বৃহৎ নয় স্থানটি। একটি কলামের ওপর দাঁড়িয়ে ছোট মানেকেন পিস। অবিরত ঝরনার মতো মূত্র ত্যাগ করেই চলছে পাথরের ডাবল আয়তক্ষেত্রাকার বেসিনে। ভাস্কর্যটি দেখে আমার আর বুঝতে অবশিষ্ট রইল না কেন প্রায় সব স্যুভিনিরের দোকানে এই নগ্ন শিশু। ব্রাসেলসের জনগণের সর্বাধিক পরিচিত ও প্রিয় প্রতীক এটি। এটি বেলজিকদের রসবোধ এবং মনের স্বাধীনতার প্রকাশ। ছেলেটি বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রাসেলস শহরটি সজ্জিত করে চলেছে। ২৪ ঘণ্টা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে স্থানটি।
১৪৫১-৫২ সালে একটি প্রশাসনিক নথিতে প্রথম এই চরিত্রটির উল্লেখ পায় বেলজিকরা। মূলত সেই তথ্যটি ছিল ব্রাসেলসের পানি সরবরাহকারী একটি ঝরনা-সম্পর্কিত। শুরু থেকেই ঝরনাটি পানীয় জল বিতরণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিল ব্রাসেলস শহরে। কথিত আছে ঝরনাটি ১৫ শতকের গোড়ার দিকে শহরজুড়ে পানীয় জলের বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। কালের পরিক্রমায় মানিকেন পিসকে নিয়ে বেশ কিছু উপকথা বা লোককাহিনি বা গল্পকথা তৈরি হয়েছে। সর্বাধিক বিখ্যাত কাহিনি হলো এ রকম: চতুর্দশ শতাব্দীতে ব্রাসেলস একটি বিদেশি শক্তি দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। আক্রমণকারীরা শহরের দেয়ালে ক্লাস্টার বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিল। তারা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জুলিয়ানস্ক নামের একটি ছোট্ট ছেলে জ্বলন্ত ফিউজে মূত্র ত্যাগ করেছিল, এইভাবে শহরটি সেদিন রক্ষা পায় বিদেশি আক্রমণকারীদের থেকে ।
আর একটি গল্প প্রায়ই শোনা যায় পর্যটকদের কাছে। এক ধনী বণিক পরিবার নিয়ে বেড়াতে গেছেন ব্রাসেলস। একসময় বণিকের শিশুপুত্রটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শিশু অনুসন্ধানের জন্য বণিকটি খুব দ্রুত একটি অনুসন্ধান কমিটি করেন এবং তারা শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় শিশুটিকে পাওয়া গেল, যখন কিনা সে একটি বাগানে মূত্র ত্যাগ করছিল। শিশু অনুসন্ধানে স্থানীয় যে লোকেরা সাহায্য করেছিলেন, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার উপহার হিসেবে বণিক ঝরনাটি তৈরি করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, আরও কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে মানিকেন পিসকে নিয়ে। আর একটি কিংবদন্তি বলে, একটি ছোট ছেলে তার মায়ের কাছ থেকে নিখোঁজ হয়েছিল। সন্তানের ক্ষতিতে আতঙ্কিত এই নারীর ডাকে শহরের মেয়র পর্যন্ত সাড়া দিয়েছিলেন। শহরজুড়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যখন শিশুটিকে পাওয়া গেল তখন শিশুটি একটি ছোট রাস্তার কোণে প্রস্রাব করছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পটি থেকে যায় এবং এই কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে ভাস্কর্যটি তৈরি হয়।
ভাস্কর্যটি এখন আর পানি বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না, এটি শহরটিকে নতুন উপায়ে সমৃদ্ধ করে আসছে। ভাস্কর্যটি মূলত উলঙ্গ হলেও মানেকেনের কিন্তু অভিজাত পোশাক আছে। তার জন্য ঘটা করে পোশাক তৈরি হয়। পোশাকের ধরন-ধারণ দ্বাদশ শতাব্দীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে বিশেষ ও জাতীয় অনুষ্ঠান এবং উৎসব উপলক্ষে মানেকেন পিসকে সাজানো হয়। ২০১৬ সালে তার জন্য ৯৫০টি পোশাক জমা পড়ে। তার পোশাক পরিবর্তনও বেশ আড়ম্বর, দেখার মতো। ব্যান্ডের সুর এবং ছন্দে এই পোশাক পরিবর্তন করা হয়।
শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে তার পোশাক পরিধান কিংবা পরিবর্তনের বিষয়াদি দেখভাল করার জন্য নাকি আছে বিশেষ এক বেসরকারি সংস্থা। ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা! বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিবছর জমা হওয়া কয়েক শ ডিজাইন পর্যালোচনা করে ব্যবহারের জন্য অল্পসংখ্যক নির্বাচন করা হয়। তার প্রায় এক হাজার বিভিন্ন পোশাক রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলি গ্র্যান্ড প্লেস-সংলগ্ন সিটি মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে দেখা যায়।
মূর্তিটি চুরি করে তা বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছিল বিভিন্ন সময়। এ কারণে এখন ভাস্কর্যটি ধাতব গ্রিল দ্বারা সুরক্ষিত। ভাস্কর্যটি সাতবার চুরি গেছে। বেলজিকদের অন্যতম বিখ্যাত এবং প্রিয় নাগরিক মানেকেন পিস।
পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় এটি শীর্ষে কিন্তু বেলজিকদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক গভীরে। তারা মনে করে, এ শিশুর মধ্যেই যেন অধিষ্ঠান তাদের ঈশ্বরের। অনেকের মতে, এটি বেলজিকদের দৃঢ়তা, কৌতুকপ্রিয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক ।
লেখক: গবেষক ও পরিব্রাজক, সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন