২০১৪ সালের কথা। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ভ্রমণে বেরিয়েছি। সঙ্গী ছোট ভাই তারেক অণু। এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়া হয়ে পোল্যান্ডের লুবলিন শহরে পৌঁছেছি। সেখানে এসে জানতে পারি, ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। শুধু আক্রমণই নয়, তত দিনে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিয়েছে, রাজধানী কিয়েভ পর্যন্ত যুদ্ধ ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আমরা মলদোভা যাব। বেলারুশ হয়েও দেশটিতে যাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা ইউক্রেন হয়ে মলদোভা যাওয়ার। ইউক্রেনের ঐতিহাসিক লভিভ, কামিয়ানেতস-পোডিলস্কি শহর ঘুরে দেখব। এই শহরগুলো দেশটির অন্যতম প্রাচীন শহর। এসব শহরে পোলিশ–অস্ট্রীয় নকশায় গড়া অনেক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। না দেখলে পূর্ব ইউরোপ ভ্রমণ অসম্পন্ন থেকে যায়!
যুদ্ধের দামামার মধ্যেও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ইউক্রেনে প্রবেশ করব। লভিভের দিকটা কিছুটা নিরাপদ। হামলার আশঙ্কাও কম। আবার তারুণ্যের রোমাঞ্চ পেয়ে বসেছে। তাই সড়কপথে লুবলিন থেকে ইউক্রেনে প্রবেশ করি। যে শহরে প্রথমে গেলাম, তার নাম আর এখন মনে করতে পারছি না। তবে সেখানে পৌঁছে স্থানীয় এক বন্ধুর সহযোগিতা পেলাম। সে-ই আমাদের হোটেল ঠিক করে দিল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে বুঝলাম সর্বতো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। মানুষের মুখে অজানা শঙ্কা। রাস্তায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর টহল। আমাদের দেখে টহলরত সেনা সদস্যরা এগিয়ে এলেন। ফিনল্যান্ড থেকে এসেছি শুনে তাঁরা সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করলেন।
পরদিন লভিভে পৌঁছে স্থানীয় এক বন্ধুর সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী এক হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। ইউক্রেনের পুরোনো শহর লভিভকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। ১২৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শহর এখন পর্যন্ত অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। এই শহরেই ইউক্রেনের বেশির ভাগ বিখ্যাত ধর্মীয় স্থাপনাগুলো রয়েছে। টাউন হল, রায়নক স্কয়ার, ব্ল্যাক হাউস, কোরনাইক্ট প্যালেস, ডমিনিকান চার্চ, লাতিন ক্যাথেড্রাল, সেন্ট জর্জ ক্যাথেড্রাল—নেহাত ছোট নয় এই তালিকা। লাল-সোনালি রঙের সঙ্গে সোভিয়েত ঘরানার মিল রেখে পুরো লভিভ শহর গড়ে উঠেছে। শহরে ঘুরতে গিয়ে বুঝলাম, পর্যটকদের প্রতি লভিভের স্থানীয় মানুষদের আচরণ অনেক বন্ধুসুলভ। যুদ্ধাবস্থাতেও সেটা মেনে চলছে তারা। আনাচকানাচে নানা ধরনের দোকান, বিশেষ করে ফুলের দোকানগুলো চোখের সামনে আজও ভাসে।
লভিভ শহরের পর আমাদের গন্তব্যস্থল কামিয়ানেতস-পোডিলস্কি শহর। স্মটরিখ নদীর তীরে অবস্থিত শহরটির মূল আকর্ষণ প্রাচীন দুর্গ। উপরি পাওনা হিসেবে রয়েছে দেশটির ঐতিহাসিক প্রাসাদগুলোর খুদে সংস্করণ নিয়ে জাদুঘর। মিউজিয়াম অব মিনিয়েচার ক্যাসেল নামে জাদুঘরটি খোলামেলা জায়গায়।
লভিভ থেকে কামিয়ানেতস-পোডিলস্কির দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। আমরা সকাল সকাল রওনা হলাম। ইউক্রেনের স্থলভূমি অনেকটা বাংলাদেশের মতো। শুধু ধানখেতের বদলে ভুট্টা ও যবের খেত চোখে পড়ল। গাড়িতে বসে রাস্তার দুই পাশের ভুট্টা ও যবের খেত, গরু বা ঘোড়ার অলস বিচরণ দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। দ্রুত খাওয়া শেষে দেখতে গেলাম ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থোডক্স চার্চ পোচায়েভ লাভরা। স্থলভূমি থেকে বেশ উঁচুতে পাহাড়ি এলাকায় ওই চার্চের অবস্থান। সোনার পাতে মোড়া গম্বুজগুলো রোদে চকচক করছিল। মন চাইছিল আরও কিছুক্ষণ থাকি কিন্তু সময়কে বেঁধে রাখি কীভাবে? ওদিকে যে জিভেনেটস গ্রামেও যেতে হবে।
১৫–১৬ শতকে পাথরের তৈরি পঞ্চভুজ আকৃতির দুর্গের জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম। যদিও বর্তমানে অনেকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিন্তু তাতে কি! গাড়িতে করে দুর্গটি দেখতে দেখতে মনে হলো আমিও যেন হারিয়ে গেছি সেই যুগে। কোলাহলমুক্ত শান্ত পরিবেশে ঘোড়ার গাড়িতে করে নাগরিকদের চলাচলের দৃশ্য মনে হলো, এখনো সেই মধ্যযুগেই আছি।
ফেরার পথে কয়েকজন ফৌজের সঙ্গে দেখা। দেশের এক প্রান্তে যুদ্ধ চলছে, তাঁদের চেহারায় সেই যুদ্ধের ছায়া। আচ্ছা, এই সেনা সদস্যরা এখন কী করছেন? রাশিয়া যেদিন ইউক্রেন আক্রমণ করল, সেদিন থেকেই তাঁদের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে আমাদের যে বন্ধুরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের কথাও। আমরা যে ঐতিহাসিক শহরগুলো ভ্রমণ করেছি, সেসব শহরে এখনো বোমা ফাটেনি। কিন্তু ফাটতে আর কত দিন। ফেলে আসা সভ্যতার নিদর্শন, যত্নে রাখা শত শত বছর আগের ঐতিহ্য কি সহজেই চূর্ণ হবে গোলার আঘাতে।