ভিয়েতনামের কাও বাং প্রদেশের উত্তরে বাও লাক ও মিও ভ্যাকের বিশাল বিশাল পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা রোমাঞ্চ জাগানোর জন্য বেশ যথেষ্ট। বাড়তি পাওনা পাহাড়ের কোলজুড়ে স্তরে স্তরে সাজানো সবুজ ধানখেত আর মাঝেমধ্যে কিছু প্রাকৃতিক গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এসব গুচ্ছ গ্রামেই বসবাস করে ভিয়েতনামের ৫৪ এথনিক গোষ্ঠীর অন্যতম পুরোনো লোলো গোষ্ঠী। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে লোলোরা পাহাড় বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভিয়েতনাম ও লাওসে। তবে চীনের পরে ভিয়েতনামেই এদের সংখ্যা বেশি, প্রায় সাড়ে তিন লাখের কাছাকাছি।
হ্যানয়ের হং নদীর মাঝিদের সঙ্গে নৌকাভ্রমণ ও আড্ডা সুযোগ এনে দিল ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যময় লোলো গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের। মাঝিদের সঙ্গে গল্পের মধ্যেই যেন হারিয়ে গেলাম পাহাড়ি লোলো গ্রামে। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে না মিটিয়ে পরের দিনই পরিকল্পনা নিলাম লোলোদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করার। যেই ভাবা সেই কাজ। হ্যানয়ের লুওং বাস টার্মিনালে গিয়ে দেড় লাখ ভিয়েনামিজ ডং (বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ৫৫০ টাকার মতো) দিয়ে টিকিট কেটে ফেললাম। মজার ব্যাপার হলেও সত্য, ভিয়েতনামের এমন লাখ লাখ ডংয়ের ছড়াছড়ি বাইরের যে কাউকেই অবাক করে ছাড়বে। বাসে উঠেই পেয়ে গেলাম এক বোতল পানি, একটা ছোট্ট কেক আর এক ঠোঙা পেস্তা বাদাম। এসব রসদ নিয়েই শুরু হলো দীর্ঘ আট ঘণ্টার বাসযাত্রা। পাশের সিটের ভদ্রলোক গোমড়ামুখে এদিক-ওদিক করছেন। আমি কথা বলার চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিলাম। কারণ ভাষাগত সমস্যায় যোগাযোগ চালিয়ে নেওয়া ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছিল। তাই বাসের জানালা দিয়ে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে চোখ ও মন পুরোদমে সঁপে দিলাম। চিরসবুজ পাহাড়, নদী, গাছপালা, নীল-সাদা আকাশের মেলবন্ধনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেন মুহূর্তেই মোহাবিষ্ট করে ফেলল।
যাত্রাবিরতিতে বাস থেকে নেমে চোখে গেল ঘন গোলাপি সাদা রঙের একটা জুসের দিকে, আগ্রহ নিবারণ করতে গিয়ে জানতে পারলাম এটা স্থানীয় মহিষের দুধ, পুরোনো পনির, বাদাম ও হার্বস দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী পানীয়। এটা পান করার সাহস না দেখিয়ে শুধু রাম্বুটানের জুস নিয়ে বাসে ফিরে এলাম। একটা অবস্থায় বাসের ঝাঁকুনি ও পাহাড়ি লম্বা পথ তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলল। গভীর ঘুম ভাঙল বাসের সাইরেনে। বাসের গাইড জানাল আমরা পৌঁছে গেছি কাও বাংয়ে। বাস থেকে নেমে একটা ফলের দোকানের পাশে পেতে রাখা লম্বা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে গাইডের খোঁজে ছুটলাম। মোটামুটি ইংরেজি জানা একজন গাইড ঠিক করে তাঁর মোটরবাইকে আরও খানিকটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে বিকেলের আলো নিভে যাওয়ার আগে যখন লোলোদের গ্রামে উপস্থিত হলাম, তখন অপেক্ষা করছিল দারুণ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
গ্রামপ্রধান মহিষের শিং দিয়ে বানানো এক ধরনের বাঁশি বাজিয়ে এবং ঐতিহ্যবাহী ভুট্টার স্যুপ দিয়ে আমাদের বরণ করে নিলেন। এরপর কয়েকজন লোলো নারী এসে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করা বেশ কঠিন ছিল। কারণ লোলোরা ইংরেজিতো দূরের কথা, ভিয়েতনামি ভাষাতেও কথা বলতে পারে না। তাই আমি ও আমার ভিয়েতনামি গাইড ইশারায় কথা চালাতে লাগলাম। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, কারণ গ্রামপ্রধান কিছুটা ইংরেজি ও ভিয়েতনামি ভাষা জানতেন।
রাতে পুরো গ্রামের বাড়িগুলোতে যখন একে একে আলো জ্বলে উঠতে লাগল, তখন মনে হচ্ছিল যেন এক ঝাঁক জোনাকি পাহাড়ের মাঝে এসে হাজির হয়েছে। মৃদু ঠান্ডা পাহাড়ি বাতাসের মাঝে এ যেন এক অপার্থিব অনুভূতি! যা-ই হোক, রাতের বেলায় আমাদের ঠাঁই হলো গ্রামপ্রধানের বাড়িতেই। সন্ধ্যারাতেই ডিনার সারতে হলো মহিষের শুকনো মাংস, পনির ও ভুট্টার আটা দিয়ে বানানো শক্ত রুটি, টমেটো ও মাশরুম পোড়া দিয়ে। ডিনারের মাঝেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন গ্রামপ্রধান। জানালেন লোলোদের নিয়ে কিংবদন্তি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।
বেশির ভাগ লোলো বিশ্বাস করে তাদের অপু ডুমু নামের একজন পূর্বপুরুষ আছেন। কথিত আছে, অপু ডুমু তিনটি বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁদের ছয়টি ছেলে ছিল; প্রত্যেক স্ত্রীর দুটি করে পুত্রের জন্ম হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, প্রাচীনতম দুই পুত্র তাদের গোত্রের নেতৃত্ব দিয়ে চীনের ইউনানের অন্যান্য আদিবাসীদের জয় করেছিল এবং ইউনানের বেশির ভাগ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। কনিষ্ঠ দুই পুত্র তাদের গোষ্ঠীকে পূর্ব দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং হান সম্প্রদায়ের কাছে পরাজিত হয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। লোলোরা পশ্চিম চীনের প্রাচীন কিয়াং সম্প্রদায় বংশোদ্ভূত। তারা দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বত থেকে সিচুয়ান হয়ে ইউনান প্রদেশে পাড়ি জমায়। এরপর তারা ছড়িয়ে যায় পাশের দেশগুলোর দুর্গম পাহাড়ের মাঝে।
লোলোরা ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র যেমন ধনুকযুক্ত স্ট্রিং ইনস্ট্রুমেন্টস, লিয়াংশান, বাউ, মাবু এবং শেংও বাজাতে বেশ পারদর্শী। এগুলো দিয়ে তারা সাধারণত প্রেম, আনন্দ ও বিরহের সংগীত পরিবেশন করে। বাদ্যযন্ত্রের গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর কখন যে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল, টের পেলাম না। বেশ ভোরে জানালার ফাঁক গলে ভোরের উজ্জ্বল আলো চোখের মাঝে উঁকি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি রাতের শান্ত-নীরব লোলো গ্রামে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কেউ মহিষ নিয়ে কৃষিকাজে বের হচ্ছেন, কেউ সুতো দিয়ে কাপড় বুনছেন, কেউ পশু-পাখিকে খাবার দিচ্ছেন, কেউ গৃহস্থালির নানা কাজ করছেন। সকালবেলা সুগন্ধি চাল, মুরগির মাংস, ডিম ও ভুট্টার স্যুপ, লেটুস পাতার ঝোল ও পাহাড়ি হার্বসের জুস খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে।
পাহাড়ি সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে না ভান গ্রামে পৌঁছে গেলাম। একদল শিশু হইচই করতে করতে আমাদের তাদের গ্রামে নিয়ে চলল। এরই মাঝে আগের গ্রামের প্রধান জানিয়েছেন, লোলোদেরকে পোশাক আশাক ও বিশেষ কিছু প্রথা মানার ওপর ভিত্তি করে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়—কালো লোলো, ফুল লোলো এবং লুং কিউয়ের লোলো। এরা গ্রামীণ ভিয়েতনামে বাস করে এবং ধান, ভুট্টা, শাকসবজি ও পশুপাখি চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। কালো লোলো, লুং কিউয়ের লোলো এবং মেও ভ্যাকের ফুল লোলো নানা প্রথা মানায় একে অন্যের চেয়ে আলাদা। প্রাচীনকালে লোলোরা ‘সর্বপ্রাণবাদী’ ধর্মীয় বিশ্বাসকে অনুসরণ করে পাহাড় ও বনের দেবতাদের উপাসনা করত। এখন অবশ্য অনেক লোলো বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি মেনে চলে।
লোলোদের পরিপাটি থাকার চেষ্টা ও পোশাকের বৈচিত্র্য ভীষণ মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল। না ভান গ্রামের লোলোরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্লাক ব্যাগি ট্রাউজার্স, কালো পাগড়ি এবং সূক্ষ্ম সূচিকর্মযুক্ত জ্যাকেট পরে। গোলাপি, সবুজ ও হলুদ রঙের বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা পোশাককে ভিন্ন মাত্রা দান করে। পোশাকগুলো রুপার অলংকার দিয়ে নকশা করা হয়। লোলোদের বিশ্বাস, এতে করে মন্দ আত্মা তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে। অনেক লোলো হাতের কাজ করা রঙিন স্কার্ফ মাথায় পরিধান করে।
আমাদের আসার সম্মানে না ভান গ্রামে বিকেলে শুরু হলো সূর্য ডোবা উৎসব। গ্রামের সবাই ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে হাজির হলো পুরোনো এক চেরিগাছের তলায়। সবাই নাচ ও গানে মেতে উঠল। লম্বা লম্বা বাঁশি, শিঙে বাজল। মোরগ লড়াই হলো। চলল স্থানীয় ভাত ও ভুট্টার বিয়ার দিয়ে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো। সূর্য দেবতার বন্দনায় এভাবেই তারা বিকেলের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাল। গোধূলির শেষ লগ্নে আমরাও না ভানের সবাইকে বিদায় জানিয়ে অনেক ভালোবাসা নিয়ে রওনা হলাম আগের বাও লাক গ্রামের দিকে।বাও লাকের লাল লোলো নারী ও পুরুষ (ঐতিহ্যবাহী পোশাকে