শফিকুলের কলের ঢেঁকি

কালের আবর্তে প্রায় নাই হতে চলেছে ঢেঁকি। গ্রামবাংলার হারানো সেই ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে এনেছেন গাইবান্ধার শফিকুল ইসলাম। পায়ে নয়, বৈদ্যুতিক মোটরে চলে তাঁর ঢেঁকি। ঢেঁকিছাঁটা চাল বিক্রি করে সফলও হয়েছেন এই তরুণ। দেখে এসেছেন শাহাবুল শাহীন

গাইবান্ধা সদর উপজেলার খামারবোয়ালি গ্রামে শফিকুল ইসলামের বাড়ি। তাঁদের বাড়ির উঠানেই একটা একচালা ঘর। তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে মোটরের শব্দ। শুনে ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। ভেতরে পাশাপাশি দুটি ঢেঁকি। উঠছে আর নামছে। কিন্তু সেগুলোতে পার (পা দিয়ে ধাক্কা দেওয়া) দিচ্ছে না কোনো মানুষের পা। কাজটি করে দিচ্ছে বৈদ্যুতিক মোটর।

ঢেঁকি দুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ধান ছাঁটাইয়ে ব্যস্ত শফিকুল ইসলাম। কাজের ফাঁকে জানালেন, নিজের বেকারত্ব ঘোচাতে কীভাবে মোটরচালিত কলের ঢেঁকিটি বানিয়েছেন তিনি। অবশ্য এমন ঢেঁকি তিনিই প্রথম বানাননি। কিশোরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে একই কায়দায় ঢেঁকির ব্যবহার আগেই দেখেছেন শফিকুল। এলাকায় তাঁর উদ্যোগটি বেশ সাড়া ফেলেছে। অনলাইনে শফিকুলের ঢেঁকিছাঁটা চালের কদরও বেশ। দুই বছর ধরে ঢেঁকিছাঁটা চাল বিক্রি করছেন তিনি। প্রতি মাসে সেই চাল বেচে আয় করছেন ৩০-৩৫ হাজার টাকা।

বৈদ্যুতিক মোটরে চলে শফিকুলের ঢেঁকি
ছবি: ছুটির দিনে

শফিকুল ইঞ্জিনিয়ার

শফিকুলকে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বলে ডাকে খামারবোয়ালির মানুষজন। এর কারণ কিন্তু ঢেঁকি নয়! আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রকৌশলী। ২০১৬ সালে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন শফিকুল। পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। করোনাকালের শুরুতে ২০২০ সালে বাড়িতে চলে আসেন তিনি।

মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার বিষয়টি তখন খুব করে আলোচনায় এসেছিল। শফিকুল ভাবলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাকৃতিকভাবেই রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অধিকারী হতেন। বড়রা বলতেন, কেনইবা হবেন না, তাঁরা বিষমুক্ত শাকসবজি খেতেন, ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খেতেন।

শফিকুল ভাবেন, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় বেশি থাকে ভাত। ভাতটা যদি পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়, তাতেই তো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেকটা বাড়ানো যায়। এরপর বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করেন বৈদ্যুতিক মোটরচালিত কলের ঢেঁকি। চার অশ্বশক্তির (ফোর হর্সপাওয়ার) একটি মোটরে একসঙ্গে দুটি ঢেঁকি চলে। এতে সময় ও শ্রম দুই–ই কম লাগে। অবকাঠামোসহ কলের এই ঢেঁকি তৈরি করতে খরচ পড়বে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

শফিকুল জানান, লালচে চেহারার ঢেঁকিছাঁটা চাল খেতেও সুস্বাদু। ঢেঁকিছাঁটা চাল বিক্রির জন্য তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালান। স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে এই চাল। অনলাইনে ও মুঠোফোনে অর্ডার আসছে। কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেই চাল। ঢেঁকিছাঁটা আমন চাল প্রতি কেজি ৮৮ টাকায় বিক্রি করছেন। প্রতি ঘণ্টায় ছাঁটাই করা যায় এক মণ ধান। দিনে আট ঘণ্টা চালু রাখতে পারেন এই ঢেঁকি। কেউ এক মণ ধান নিয়ে এলে ছাঁটাই করে চাল বের করতে লাগবে ১৫০ টাকা। চালকলে অবশ্য এক মণ ধান ভাঙতে লাগে ৩০ টাকা।

ঢেঁকিছাঁটা চালের উপকারিতা

পুষ্টিবিদেরা বলছেন, ঢেঁকিছাঁটা চালে রয়েছে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসহ নানা পুষ্টিগুণ। সাধারণ চালের চেয়ে এই চালে আঁশের (ফাইবার) মাত্রা বেশি। ফলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে। ফলে ঘন ঘন খিদে পাওয়ার প্রবণতা কমায়। এই চালে থাকা ফাইবার ওজন কমাতেও সাহায্য করে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। এ ছাড়া এই চাল আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। পাশাপাশি স্নায়বিক রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই চালে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন বি এবং ই। রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, প্রোটিন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো পুষ্টিগুণ।

কর্মসংস্থান তৈরির স্বপ্ন

শফিকুল ইসলাম তাঁর এই ঢেঁকি প্রকল্পের নাম দিয়েছেন এসওএ বাংলাদেশ (শফিকুল, অরুণা, আফছার বাংলাদেশ)। অরুণা ও আফছার তাঁর মা-বাবা। বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে গেছে এসওএ বাংলাদেশের পণ্য। তবে শফিকুলের স্বপ্ন আরও বড়। তিনি চান বিনিয়োগকারী কিংবা সুদবিহীন ঋণ। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি ইলেকট্রিক ঢেঁকি স্থাপন করতে চান তিনি। যেখানে দুই–আড়াই শ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। স্বপ্ন পূরণের পথে কিছুটা এগিয়েছেনও শফিকুল। বাড়ির কাছে ২২ শতাংশ জমি কিনেছেন। এখানেই হবে তাঁর ভবিষ্যৎ ‘ঢেঁকি-প্রকল্প’।

শফিকুলের ঢেঁকির চারটি অংশ
ছবি: ছুটির দিনে

শফিকুলের ঢেঁকি

শফিকুলের ঢেঁকির চারটি অংশ: যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, কাঠ ও অবকাঠামো। যান্ত্রিক অংশে পাঁচটি চাকা (পুলি) ব্যবহার করা হয়েছে, দুটি লোহার শ্যাফট, দুটি বেল্ট, চার সেট বিয়ারিং এবং লোহা ব্যবহার করা হয়েছে। এসব যন্ত্রাংশ সাধারণ অবকাঠামোর ওপর স্থাপন করা হয়েছে। মূলত এসব যন্ত্রাংশ দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঢেঁকির গতি।

বৈদ্যুতিক অংশের প্রধান যন্ত্রাংশ হচ্ছে মোটর। এটি চার অশ্বশক্তির একটি সিঙ্গেল ফেজ মোটর। উচ্চমানের কেবলের মাধ্যমে প্রধান ব্রেকার থেকে সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এই মোটরের বৈদ্যুতিক লাইন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে আরেকটি আলাদা এমসিবি (প্রধান কন্ট্রোল বোর্ড)। মোটরকে শীতল রাখার জন্য বাতাস দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোটরটি একটি ধাতব ফ্রেমের ওপর বসানো।

কাঠের অংশ মূলত ঢেঁকি। দৈর্ঘ্য সাড়ে ৬ ফুট, প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। মাঝখানের তুলনায় ঢেঁকির সামনের ও পেছনের অংশ প্রশস্ত। সামনের দিকে বসানো নাকসলাই (লাঠির মতো) দিয়ে ধান ছাঁটাই করা হয়। অনবরত এটি সিমেন্টের গর্তে পড়তে ও উঠতে থাকে। সেই গর্তে ধান রাখা হয়, পর্যায়ক্রমে যা থেকে বেরিয়ে আসে চাল।