সেদিনের সকালটা শুরু হলো বৃষ্টি দিয়ে। টানা চার দিন ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল স্কটিশ গ্রীষ্মময় দিন শেষে অবশেষে দেখা মিলল পাহাড়ি বৃষ্টির। স্কটিশ হাইল্যান্ডে তুখোড় চারটা দিন কাটিয়ে আগের রাতেই ফিরে এলাম গ্লাসগো শহরে। খেয়েদেয়ে আর মুঠোফোনের স্ক্রিনে যত্ন করে রাখা হাইল্যান্ডের স্মৃতিগুলো উপভোগ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মনেই নেই। লম্বা একটা ঘুম দিয়ে সকালে লজের বারান্দার বসে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে উপভোগ করলাম অঝোর ধারায় স্কটিশ ধারাপাত।
আমি বৃষ্টি ভালোবাসি, নদী ভালোবাসি, পাহাড় ভালোবাসি। ভালোবাসি আমার শহর সিলেটকে। বৃষ্টি, নদী আর পাহাড়ের সান্নিধ্যে যাওয়া মানেই মায়ের কাছে যাওয়া, আমার শহর সিলেটের কাছে যাওয়া। পাহাড়ি ঢলে বান ডাকা আমার ক্ষীণমধ্যা তন্বী শ্যামাঙ্গী দেওরভাগা নদীতে ডুবসাঁতারে এপার–ওপার করা।
এমন উপভোগ্য বৃষ্টির ধারার মধ্যেই মনের মধ্যে একটুখানি দুঃখবোধও হচ্ছিল। কারণ, হিসাবমতে একটু পরেই আমাদের রওনা হওয়ার কথা ইতিহাস, স্থাপত্য, ঐতিহ্য, শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে ভরপুর শহর এডিনবরায়, যেটা স্কটল্যান্ডের রাজধানীও বটে। ঘণ্টাখানেক পরেই দেখি বৃষ্টি ধরে এসেছে। এদিকে সব গুছিয়ে মৌনীও প্রস্তুত। ব্যস, শুরু হলো আমাদের এডিনবরার উদ্দেশে যাত্রা।
আমাদের লজ থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম হেঁটেই ঢুকে গেলাম গ্লাসগোর আন্ডারগ্রাউন্ডে। এটা লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের তুলনায় একেবারেই শিশু, তবে বেশ ছিমছাম এবং ফাঁকা। কয়েকটা স্টেশন পেরিয়েই কুইন স্ট্রিট। গ্লাসগোর সেন্ট্রাল রেলস্টেশন। সেখান থেকে স্কট রেলে ঘণ্টাখানেকের পথ।
বৃষ্টি তখনো ধরেনি। ট্রেনে ওঠার পরে মনে হলো বৃষ্টির তোড় যেন আরও একটু বাড়ল। ট্রেনের সিটে গা এলিয়ে দেখছি পাহাড় আর বৃষ্টির অপূর্ব সংযোগ। হাতে গরম কফি, হেডফোনে পণ্ডিত ভীমসেন যোশি আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের যুগলবন্দীতে বাজছে তানসেনের বিখ্যাত মিয়া কি মল্লার রাগের কম্পোজিশন। সব মিলে ধরা দিল যেন এক অপূর্ব সকাল।
ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে চলছে এডিনবরার পথে। এডিনবরা বা এডিনবার্গ যে নামেই ডাকুন না কেন, এই শহরের প্রাচীন নাম ডান ইডিয়ানান এবং গোড়াপত্তন কিন্তু মিসোলিথিক সময়ে; যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৭৮ সালে ড্যাডিংটন লখ থেকে উদ্ধার হওয়া লৌহযুগের কিছু অস্ত্র।
আধুনিক এডিনবরা বা এডিনবার্গের নামকরণ করা হয় এডুইনস ফোর্টস থেকে। এডুইন থেকে এডিন আর বার্গ মানে দুর্গ বা ফোট্রেস। সপ্তম শতকে ডান ইডিয়ানান ছিল তৎকালীন রাজ্যগুলোর অন্যতম নর্দামব্রিয়ার অধীনে। সেই সময়ে এডুইন দ্য কিং অব নর্দামব্রিয়া ছিলেন প্রভাব-প্রতিপত্তিওয়ালা রাজাদের একজন। পনেরো শতকে এডিনবার্গকে স্কটল্যান্ডের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন রাজা চতুর্থ জেমস।
অ্যাংলো-স্যাক্সন থেকে শুরু করে ভাইকিংস অনেকেই দখল করেছেন এডিনবরা শহরকে। এসেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এভাবেই হাজার হাজার বছরের পুরোনো স্থাপত্য আর সংস্কৃতিকে ধারণ করে গড়ে উঠেছে আজকের এডিনবার্গ। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের বিবিধ রতন।
ইতিমধ্যে আমাদের ট্রেন পৌঁছে গেছে এডিনবার্গের সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন ওয়েভারলিতে। নেমেই মনে হলো পৌঁছে গেছি কোনো প্রাচীন সাম্রাজ্যে। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে জৌলুশপূর্ণ, আভিজাত্যমণ্ডিত প্রাচীন ভবনগুলো।
বাইরে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি ধরে গেছে। স্টেশন থেকে নিয়ে নিলাম ট্রাভেলার্স লিফলেট, শহরের ম্যাপ আর বাসপাস। হাঁটতে হাঁটতে ওয়েভারলি ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ইউরোপের সব থেকে প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক এডিনবার্গ ক্যাসলে। বিশাল পাথরখণ্ডের ওপরে সদর্পে দণ্ডায়মান এই দুর্গ যেমন জৌলুশপূর্ণ, তেমনি ঐতিহ্যময়। এই ক্যাসল বহু শতক ধরে স্কটিশ রাজা–রানিদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল স্কটিশ মিলিটারি গ্যারিসন এবং বন্দিশালা। ধীরে ধীরে আমরা যখন পাহাড়ি পথ বেয়ে ক্যাসল অভিমুখে যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল শত বছর ধরে স্কটিশ রাজা-রানিদের হাঁটা পথে আমরাও সঙ্গী হলাম পান্থসখা হয়ে।
ততক্ষণে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হওয়ার জোগাড়। পথপাশের একটা ক্যাফেতে দুপুরের খাবার শেষে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম রয়্যাল মিল এবং প্যালেস অব হলিরড হাউসের পিপলস স্টোরি মিউজিয়াম। সেখান থেকে গেলাম রাইটার্স মিউজিয়ামে, যেখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস, ওয়াল্টার স্কট আর রবার্ট লাইন স্টিভেনসনের প্রতিকৃতি আর হাতে লেখা কবিতার খাতা।
ততক্ষণে মেঘ আগল উপেক্ষা করে উঁকি দিলেন দিনমণি। সেই আনন্দে আমরাও হাঁটতে লাগলাম দিগ্বিদিক। যাত্রাপথে চোখে পড়ল সেন্ট গ্যালিস ক্যাথিড্রাল। তেরো শতকের শুরুতে তৈরি ১৬১ ফুট উঁচু আর্চ সমন্বিত এই ক্যাথিড্রালের স্থাপত্যশৈলী হার মানাবে ময়দানবের কারুকার্যকেও।
এরপরেই গেলাম ৪৩৮ বছরের প্রাচীন আর বিখ্যাত এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। মনে হলো যেন প্রবেশ করছি কোনো রাজ শিক্ষালয়ে। কী অপূর্ব স্থাপত্য! চোখ জুড়িয়ে যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছেন থিওরি অব ইভল্যুশনের জনক চার্লস ডারউইন, টেলিফোন যন্ত্রের আবিষ্কারক স্যার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং হ্যারি পটার গল্পের লেখিকা জে কে রাউলিং।
এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক এবং গবেষক ডক্টর হুমায়ুন আজাদ। বিশেষ করে চার্লস ডারউইনের কথা মনে হচ্ছিল বারবার। কারণ, যে লোকটা তৎকালীন কট্টর ক্যাথলিক সমাজে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছিলেন বিবর্তনবাদের কথা, যা আজকের বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হলেও প্রকাশ্যে এই নিয়ে আলোচনা করলে রোষানলে পড়তে হয় মুক্তচিন্তার মানুষদের।
আমরা হাঁটছি, প্রায় প্রতিটা ভবনেই আটকে যাচ্ছে চোখ। ইত্যবসরে হলিরডের স্কটিশ পার্লামেন্ট ভবন পেরিয়ে চলে এসেছি আর্থার সিটের কাছাকাছি। ৬৪০ একরজুড়ে হলিরড পার্কের সর্বোচ্চ চূড়া হলো আর্থার সিট; যার উচ্চতা ৮২০ ফুট। পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে বানানো ছোট রাস্তা ধরে হেঁটে ওঠা যায় এডিনবরা শহরের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্টে। যেখান থেকে পাখির চোখে দেখা যায় গোটা শহর।
আর্থার সিট থেকে নেমে আসার পরে মনে হলো পেটের সব খাবার যেন উধাও হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো আরও একটু হেঁটে বিখ্যাত প্রিন্স স্ট্রিটে গিয়ে হালকা নাশতা করে এবং পা দুটোকে বিশ্রাম দিয়ে আবারও শুরু হবে শেষ বিকেলের মিশন এডিনবার্গ। প্রিন্স স্ট্রিট হলো নিউ টাউনের আধুনিক এলাকা। অথচ সেই প্রিন্স স্ট্রিট গার্ডেনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ঘড়ি, যা তৈরি হয়েছিল ১৯০৩ সালে।
যে জায়গায় গিয়ে শেষ হলো আমাদের মিশন এডিনবার্গ, তার নাম কার্লটন হিল এবং স্কটিশ ন্যাশনাল মনুমেন্ট। রাস্তার লেভেল থেকে খানিকটা উঁচু কার্লটন হিলে উঠলে গোটা শহরের একটা প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। কার্লটন হিলের নিচেই প্রাচীন রয়েল হাইস্কুল যেখানে পড়েছেন বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কট। কার্লটন হিলের অন্য পাশে রয়েছে ন্যাশনাল মনুমেন্ট অব স্কটল্যান্ড; যা তৈরি হয়েছিল ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ধরে চলা নেপোলিওনিক যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
কার্লটন হিলে ঠিক বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কবি রবার্ট বার্নসের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই লেখা কবিতা ‘এ রেড, রেড রোজ’-এর দুটো লাইন পড়লাম এবং তাৎক্ষণিক ভাবানুবাদ উচ্চারণ করতে করতে শেষ হলো আমাদের স্কটল্যান্ড ভ্রমণের দিন।
O my Luve is like a red, red rose
That’s newly sprung in June;
O my Luve is like the melody
That’s sweetly played in tune …
আমার ভালোবাসা গোলাপের মতো লাল
প্রতিটি বসন্তে সয়লাব হয়ে ফোটে
আমার ভালোবাসা ঠুমরি ভাটিয়াল
গান হয়ে যায় তোমার দুটি ঠোঁটে ...
যদিও যাওয়া হয়নি স্কটিশ ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনে। দেখা হয়নি এডিনবার্গের বিখ্যাত ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যাল, যা শুরু হয় আমাদের ভ্রমণের সময়ের মাস দুয়েক পরে। আসলে প্রিয় কোনো কিছুরই সব রহস্য একসঙ্গে ভেদ করতে নেই। তাহলে হয়তো আকর্ষণে ভাটা পড়ে। যদিও স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চল আকাশের মতো নতুন। প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনে গোটা অঞ্চল সাজে ভিন্ন রূপে। শীতকালে স্কটল্যান্ড নাকি ভীষণ সুন্দর।
শ্বেত শুভ্র তুষার আর প্রকৃতি নাকি দেখার মতো। সেই রূপ হয়তো আস্বাদন করব কোনো এক ক্রিসমাসের ছুটিতে। আপাতত ব্যাকপ্যাক নিয়ে ছুটছি এডিনবার্গ এয়ারপোর্টের দিকে। গন্তব্য রোমানদের হাতে তৈরি গ্রেট ব্রিটেনের কর্মব্যস্ত শহর লন্ডন। যে শহরেই আস্তানা গেড়েছি বাকি জীবনের জন্য। পেছনে পড়ে রইল প্রাণ, প্রকৃতি, সাহিত্য আর স্থাপত্যের শৈলীতে গাঁথা মোহময় রবার্ট ব্রুসের দেশ স্কটল্যান্ড।
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ