আইন থাকতেও কেন পণ্যর মূল্য-মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়?

রমজান মাস এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামহীন হয়ে পড়ে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কেন বাড়ে, তা অনুসন্ধান করে বিশ্লেষকেরা উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাপ্রবণতা, পরিবহনব্যয় বৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি, ক্রেতাদের অধিক ক্রয়প্রবণতা, অপর্যাপ্ত বাজার পর্যবেক্ষণসহ কয়েকটি কারণ।

মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পবিত্র রমজানে পণ্যদ্রব্যের মূল্যছাড় দেওয়া হয়। বাজারদর স্বাভাবিক রাখতে সরকারিভাবে নজরদারি চলে এসব দেশে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। সারা বছর যা–ই হোক, রোজার সময় সবাই নড়েচড়ে বসেন দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করে, আইন প্রয়োগ করে এবং নির্দিষ্ট পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই হলো লক্ষ্য। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পবিত্র রমজান মাসে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জোরদার করা হয়। প্রতিবছর রমজান মাসে বাংলাদেশে ১০ থেকে ২০ পণ্যের দাম বাড়ে। সরকার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়, তাহলে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেছেন, ‘গত তিন বছরে বাংলাদেশে মাংসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে প্রতি কেজি মাংস ৩০০ টাকায় বিক্রি সম্ভব।’

বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য ও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থা হলো বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। ভোক্তাদের অধিকার দেখার জন্য রয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩—এই দুটি আইনের মাধ্যমে সরকার দেশে বাজার মনিটরিং করে থাকে। দেশে ভোক্তাদের অধিকার দেখার জন্য দুটি আইন থাকার পরও কেন পণ্যে ভেজাল বন্ধ হচ্ছে না এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিএসটিআই রমজান মাসে খোলাবাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা ক্রয় করে ল্যাবে পরীক্ষা করে। বিএসটিআইয়ের মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার প্রতিবেদন পেয়েছে। সেখানে ৫২টি পণ্য পরীক্ষায় মান নিশ্চিত করতে না পারায় অকৃতকার্য হয়েছে। ১২ মে হাইকোর্ট এই ৫২ পণ্যকে ভেজাল ও নিম্নমানের হিসেবে আখ্যায়িত করে এসব পণ্য বিক্রি, বাজারজাতকরণ ও উৎপাদন বন্ধ করে ১০ দিনের মধ্যে বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন।

২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ প্রণীত হয়েছে। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হলে আইন অনুযায়ী অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। দায়ের করা অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত ও জরিমানা আরোপ করা হলে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’–এর ধারা ৭৬(৪) অনুযায়ী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীকে প্রদানের বিধান রয়েছে। অধিকাংশ ক্রেতা ও ব্যবসায়ী জানেই না আসলে ভোক্তা অধিকার আইনে কী বলা হয়েছে। ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজই কী কী? জনসচেতনতার জন্য সবাইকে জানা প্রয়োজন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ কী এবং এই আইন অনুযায়ী ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজই কী? ভোক্তাদের এ বিষয়ে জানতে হবে এবং তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

অর্থনীতির ভাষায়, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই ভোক্তা। প্রত্যেক ভোক্তার রয়েছে অধিকার। কিন্তু ভোক্তার অধিকার কী, তা জানেই না অধিকাংশ ভোক্তা। ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজগুলো হলো—

১. কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কেনা পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করার প্রস্তাব দেওয়া

২. জ্ঞাতসারে ভেজালমিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করার প্রস্তাব করা

৩. জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মেশানো, যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে নিষিদ্ধ দ্রব্য মেশানো কোনো পণ্য বিক্রি করা বা বিক্রির প্রস্তাব করা

৪. কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা

৫. প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা

৬. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজনের চেয়ে কম ওজনের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা

৭. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া

৮. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত ওজনের চেয়ে কম পরিমাপের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা

৯. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কোনো কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া

১০. কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা

১১. মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় করা বা করতে প্রস্তাব করা এবং

১২. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে—এমন কোনো কাজ করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব পরিস্থিতির উদ্ভব হলে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ দাখিল করলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

ভোক্তার নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন–২০১৩’ নামে আরও একটি আইন করেছে। এই আইন সরকার ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করেছে। যেখানে ভেজাল, দূষিত বা অনিরাপদ খাদ্য বিক্রি করা হলে ক্রেতা যদি অভিযোগ করে আর এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিক্রেতার সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য আইনের ধারা ৬৬ ও ৭৮ অনুযায়ী ভোক্তা হিসেবে আপনার কাছে ভেজাল, দূষিত বা অনিরাপদ খাদ্য বিক্রি করা হলে এবং আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন। ধারা ৬৪, ৬৫ ও ৬৬ অনুযায়ী ভোক্তা হিসেবে আপনি ইচ্ছা করলে মামলা দায়েরের কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপনার জেলার বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩–এর ধারা ৬২ অনুযায়ী আপনার অভিযোগ প্রমাণিত হলে এবং খাদ্য আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে কোনো অর্থদণ্ড আরোপ করলে আদায়কৃত অর্থের ২৫ শতাংশ অর্থ প্রণোদনা হিসেবে আপনি পাবেন।

শুধু আইন দিয়ে পবিত্র রমজানে বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি। নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ থাকা দরকার। পাশাপাশি মাঠ (ফসলের খেত) থেকে বাজার পর্যন্ত যাতে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পণ্যসামগ্রী পৌঁছাতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিক হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ও পণ্যের মান উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এম এ আলিম খান, উন্নয়নকর্মী