পরীক্ষা বন্ধ হোক, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নয়

উপমা মাহবুব
উপমা মাহবুব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব পরীক্ষা তুলে দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ঘটনায় আশপাশের মানুষ দারুণ খুশি। আমি কিন্তু বেশ শঙ্কার মধ্যে আছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বলে কথা! সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করে মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে তো, নাকি হুট করে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে? মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে গিয়ে আমাদের সন্তানদের গিনিপিগ বানানো হবে না তো? তাতে উল্টো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি নয় কি?

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কৌতূহলী হয়ে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নেটে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। জানলাম, বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থার দেশ ফিনল্যান্ড। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজকে অসাম্যতামুক্ত রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফিনল্যান্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে শিশুর মনন ও মেধার বিকাশে বিশ্বাসী। দেশটি পড়ালেখার ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করে না। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্কে দারুণ একটি মন্তব্য পড়লাম, real winners do not compete.

ফিনল্যান্ডে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুল। প্রাইমারি স্কুলে কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয় না। প্রতি ১২ জন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে একজন শিক্ষক। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের বেতন মার্কিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চেয়েও ১০ শতাংশ বেশি। দেশের স্নাতকোত্তর পাস করা ব্যক্তিরাই শুধু এ পেশায় ঢোকার সুযোগ পান, অর্থাৎ শিক্ষকেরা অত্যন্ত মেধাবী। সেখানে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা ছাত্রদের বন্ধুপ্রতিম। তাঁরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ভালো-মন্দ, সবল দিক, দুর্বল দিক জানেন। আপনজনের মতো ভালোবাসা দিয়ে হাতে–কলমে শেখান। তাঁদের তাই শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করানোর প্রয়োজন পড়ে না।

শুধু কি তা–ই, একেকটা ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা লম্বা বিরতি পায়। তারা তখন বিশ্রাম নিতে পারে। তাদের কোনো হোমওয়ার্ক করা লাগে না। বরং পড়ালেখার মতো সমান গুরুত্ব দিয়ে তারা খেলাধুলা করে, গান, নাচ, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো শেখে। ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোয় লেখাপড়া বেতনবিহীন। দুপুরের খাওয়ারও ফ্রি। এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাস করে যারা উচ্চতর পড়ালেখা করছে, তাদের কাছে নাকি গণিত আর বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার শিক্ষার্থীরা হার মানছে।

ফিনল্যান্ড তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার শুরু করেছে সেই সত্তরের দশক থেকে। দীর্ঘসময়ের পরিক্রমায় আজ সেই সংস্কারকাজ একটা স্বার্থক রূপ পেয়েছে। সেখানে কবে থেকে প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ হয়েছিল, তা জানি না। তবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যে হয়নি, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থার দেশগুলোতেও নিশ্চয় সময় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ধীরে ধীরে নতুন কোনো পদ্ধতি চালু করা হয়।

সেখানেই আমার সব শঙ্কা। আমি অবশ্যই চাই যে আমার ছয় বছর বয়সী কন্যাশিশুর যেন পরীক্ষা নামক প্রতিযোগিতায় নামা না লাগে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু আমি আশা করব, তাঁর এই নির্দেশনা বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মহাপরিকল্পনার একটা অংশ হবে। তাড়াহুড়ো করে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়া যেন এই পদ্ধতি চালু না হয়ে যায়। এর জন্য যদি সময় লাগে লাগুক। যদি আমার সন্তান নতুন নিয়মের আওতায় না আসে, তাহলে না আসুক। বৃহত্তর স্বার্থে নিজের সুখ বিসর্জন দিতে রাজি আছি।

কাল থেকে যদি স্কুলে সব পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা পরীক্ষার বদলে অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করে শিশুদের বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক শেখাবেন, তা ঠিকমতো না জানেন, তাহলে তো পরীক্ষা বন্ধ হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বুমেরাং হবে। আমাদের দেশে এমনিতেই ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কম, পাড়ায় পাড়ায় এখন আর খেলাঘর টাইপ সংগঠন বা ক্লাব নেই। শিশুরা বই পড়ে না, দল বেঁধে খেলাতে যে যাবে, তার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তারা শুধু জানে দিনরাত স্কুলের পড়া পড়তে, মোবাইল টেপাটিপি করতে আর টিভি দেখতে। পড়ালেখার চাপ কমে গেলে এই শিশুরা কী করবে? স্কুলগুলো কি তার জন্য গান, নাচ বা আবৃত্তির ক্লাস শুরু করবে? তার জন্য খেলাধুলার সুযোগ করে দেবে? শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য যে অবকাঠামো দরকার, তা আমাদের দেশের কয়টি স্কুলে আছে?

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ, এই চমৎকার সিদ্ধান্ত তাড়াহুড়ো করে বাস্তবায়ন করবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্কুলে যদি লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়, সেই দায় কে নেবে? সৃজনশীল পদ্ধতি একটি অত্যন্ত ভালো পদ্ধতি। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় আমাদের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আপনারা সময় নিন। সঠিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করুন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে স্কুল এবং শিক্ষকদের পরীক্ষাপদ্ধতির বদলে অন্য শিক্ষাপদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করুন। আমরা চাই একটা ভালো পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। তাতে যত সময় লাগে লাগুক। আমরা না হয় একটু অপেক্ষা করলাম।

উপমা মাহবুব, লেখক এবং উন্নয়ন পেশাজীবী।
[email protected]