ডিভোর্স লেটার

ইনাম আলী একমাত্র প্রবাসী ছেলেটাকে দেশে এনে বিস্তর টাকাপয়সা খরচ করে মহা ধুমধামে বিয়ে দিল তিন মাসও হয়নি। এর মধ্যেই ওদের বিবাহবিচ্ছেদ! চিঠিটা খুলতেই ইনাম সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আজকাল বিয়েশাদি কতই না সস্তা, বিবাহবিচ্ছেদ–সেপারেশন বিষয়গুলো যেন আরও ভয়াবহ মাত্রায় সস্তা!!

***
১০ বছর আগের একদিন—জগিং শেষে রমনা পার্কের বেঞ্চে বসে ইনাম সাহেব একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। খানিক বাদে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক তাঁকে সালাম দিয়ে বড় বেঞ্চটার আরেক পাশে বসে পড়লেন। আগে বেশ কয়েকবার দুজনের চোখাচোখি হলেও আজই প্রথম কথা হলো।

খানিক বাদে ইনাম আলী ভদ্রতাবশত ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,

প্রায়ই দেখি আপনাকে। ভালো আছেন না!

জি ভাই, ভালো। আমি মুরাদ, একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। সিরাজগঞ্জে ছিলাম। ছ মাস হলো ঢাকাতে বদলি হয়ে এসেছি।

বেশ, ভালো। বিয়েশাদি করেছেন তো। পরিবার নিয়ে আসছেন।

জি ভাই, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। পরিবার এখনো ওখানেই আছে। ব্যাংকের কয়েকজনের আমার মতো ব্যাচেলর কলিগ এই দিলু রোডে একটা বাসাবাড়িতে মেস করে আছি আপাতত।

ঢাকা শহরে একলা থাকা তো ভীষণ কষ্টের। আমার নাম ইনাম আলী, কম্পিউটার আর ইলেকট্রনিকস পার্টসের ব্যবসা। এলিফ্যান্ট রোডে আলপনা প্লাজায় তিনটা শোরুম আছে। ওই কোনোমতে দিন আনি দিন খাই অবস্থা আরকি। আপনার ছেলেমেয়েরা বড় তো, কোন ক্লাসে পড়ে!

ভাই, ছেলেটা সিরাজগঞ্জ সরকারি জিলা স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে, আর মেয়েটা সবে তিন বছর; ওর চিন্তা দেরি আছে। একটু থিতু হয়ে নিই, তারপর ওদের এনে এখানেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।

মুরাদ সাহেব কী যে বলেন, দেরি আছে মানে! ঢাকা শহরে কোনো স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করাতে কমপক্ষে ২ বছর আগেই ভর্তি কনফার্ম করতে হয়। হায় হায়, এখনো মেয়েকে ভর্তি করাননি! ওকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন কি না আমার সন্দেহ আছে।

(ঢোঁক গিলল মুরাদ) ভাইসাব, সঠিক বুঝতে পারলাম না!

আরে ভাই, ঢাকা শহরে বাচ্চাদের স্কুলের ভর্তির খবর রাখেন। যেকোনো ভালো স্কুলে নিয়া যাবেন সিট নাই, নাই মানে নাই। এ জন্য ২-৩ বছর বয়সেই ওদের ভর্তি করিয়ে ফেলতে হয়। তবু কপাল ভালো হইলে সিট পাবেন!

মুরাদ এবার হেসে ওঠে, ভাই, অমন ভালো স্কুলে ভর্তিই না হয় করলাম না। ভালো–মন্দ তো নিজের কাছে। আমার তো মনে হয় পরিবারই হলো বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় স্কুল।

ইনাম আলী মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। বিড়বিড় করে বলে, বেডায় ঢাকা শহর আইছ শুক্কুরে শুক্কুরে হবে দুই দিন, হাওয়া বোঝো নাই মিয়া, লই যাইয়ো স্কুলে ভর্তি করাইতে, ঠেলাটা তহন বুঝবা।

মুরাদ জিজ্ঞেস করে, ভাই, আপনার বাচ্চাকাচ্চা কয়জন?

এই যুগে বেশির ভাগ মানুষজনের যা, তাই-ই। ওই এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েরে বিয়ে দিছি। জামাইয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। ছেলেটা ও লেভেলে পড়ে, আমেরিকান কারিকুলাম!

আচ্ছা, দারুণ তো! ছেলের লেভেল শেষ হলে কোথায় ভর্তি করাবেন!

কোথায় আর! এই দেশে কি আর ভালো লাইন আছে। ইংলিশ মিডিয়াম শেষে, ওই এক আইবিএ আর দুই–চারটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। তবু মনমতো সাবজেক্ট নেই, সিট নেই, কত কী! আইবিএতে কতজনই আর চান্স পায়! প্রাইভেটগুলোতেও সিটের সংখ্যা সীমিত। সব কটির মান এক রকম ভালো না। কে যাবে এত্ত সব ঝক্কি ঝামেলায়...দেশের বাহিরেই পাঠাতে হবে...

দেশের বাহিরে পড়াতে নাকি অনেক খরচ! আমি নিজেও অঙ্ক করে দেখছি যতই বলুক স্কলারশিপ, যে খরচ হয় তা দিয়ে আমার চৌদ্দ পুরুষের খরচ হয়েও কিছু আরও চৌদ্দপুরুষ পড়ানো যায়।

তা খরচ তো হয়ই!

ইনামের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে, বহুকাল আগে ঢাকা–মাওয়া হাইওয়ের পাশে সস্তায় একটা ৫ কাঠা জমি কিনেছিল, ভবিষ্যতে সুযোগ হলে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ী নিবাস গড়বে, এই ছিল পরিকল্পনা। ব্যবসা করে যা টাকাপয়সা এসেছে, মোটামুটি বাচ্চাদের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে, বিদেশ পাঠানো, বউয়ের চিকিৎসা খরচ করাতেই শেষ। ইনাম আলীর দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়। জমিটা বেচেই যে সব খরচ উঠবে, তা–ও না। সে ভেবেই রেখেছে, পৈতৃক সূত্রে গ্রামে বেশ কিছু জায়গাজমি পেয়েছে, সেগুলোও বেচতে হবে।

মুরাদ নীরবতা ভেঙে বলে, ভাই, এত কষ্ট, এত পরিশ্রম করেন। একটা বাচ্চা তো চলেই গেছে! আরেকটাকেও পাঠায় দিবেন! তাইলে আপনাদের থাকল আর কী!

ইনাম সাহেবের বুকে ধক করে ওঠে। এ কথা যে সেও ভাবেনি তা নয়। ওদের মা তো মেয়েকে দেখতে না পাবার শোকে অসুস্থই, দুই দিন পরপর শুধু কান্নাকাটি করে। ছেলেটাকে পাঠালে কেমন করে সামলাবেন স্ত্রীকে, সেটা ভাবলেও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। সবাই অবশ্য ইনাম আলীকে চেনে কঠিন শক্ত মানুষ হিসেবে। অন্তত ভাবটা তাই ধরে রাখেন তিনি। কিন্তু একা হলেই তার বুকের ভেতরেও মোচড় দেয়, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আবার সামলেও নেয়। মাঝে মাঝে ভাবে, এত কষ্ট করে কীই–বা পেলেন তারা! ছেলেটাও বাইরে চলে যাবে, ইচ্ছে হলেই দেখতে পাবে না, ছুঁতে পাবে না ভাবলেই তার চারপাশে দেয়ালগুলো যেন চেপে আসতে শুরু করে।

ইনাম আলী দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলে, কী আর করা, পড়াশোনা তো আর থামিয়ে দেওয়া যাবে না! ছেলের এখানে পড়াশোনা শেষে ভালো কোথাও পড়তে অবশ্যই বিদেশে যেতে হবে।

ভাইজান, কিছু মনে না নিলে একটা প্রশ্ন করি!

করে ফেলেন ভাই!

আপনার ছেলে ভালো পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ কী হতে পারবেন?

মুরাদ প্রশ্ন করে ইনামের দিকে তাকায়। ইনাম প্রশ্নের ধরন শুনে কিছুটা হকচকিত হয়। কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারে না। মুরাদ নিজেই বলতে শুরু করে,

ভাই, আমিই নাহয় বলি। ধরেন, সর্বোচ্চ যা হতে পারবে তা হলো, নাসার বিজ্ঞানী, গুগল আমাজনের প্রধান সিইও, সিলিকন সিটির প্রধান নির্বাহী অথবা তর্কের খাতিরেই ধরে নিই, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাতে কী! হবেটা কী? আপনার কিছু আসে যায় তাতে, যদি বিপদের সময়, প্রয়োজনে অথবা মৃত্যুতেও সন্তানকে পাশেই না পেলেন! বড়জোর আপনার যা উপকার হবে তা হলো, আপনি ব্যাপক খুশি হবেন, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারবেন, মাস গেলে ছেলে টাকা পাঠাবে, আবার না–ও পাঠাতে পারে, বিদেশি সাবান সুগন্ধি লোশন ব্যবহার করবেন। এই তো! তারপর ঘরে ফিরে বুড়া-বুড়ি আবারও সেই একা। একাকিত্বের দংশন। আদরের ধন সন্তানদের মনে পড়ার বেদনা।

হাতের আধা লিটারের পানির বোতলে চুমুক দেয় মুরাদ। আবার শুরু করে,

ধরেন, আপনার সন্তান যদি নিতান্ত দয়াপরবশ হয়, আপনাদেরকে তার কাছে বিদেশে নিয়েও গেল। ভালো লাগবে না। আশপাশে যাদের দেখবেন, যা কিছু শুনবেন, সব অপরিচিত, কৃত্রিম মনে হবে। কারও সঙ্গে মন খুলে দুটো কথা বলতে পারবেন না, কাউকে ধমকও দিতে পারবেন না। আপনার ছেলের দেওয়া রোলস রয়েস গাড়িতে চড়ে সারা দিন ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু তাতে কি শান্তি পাবে মন! কেউ দেখবে না, জানবেও না। এমন গাড়ি আমার দেশে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে, সেখানে সবারই অমন দু–চারটা গাড়ি আছে। আপনারা টিকতে পারবেন না। দেশে চলে আসবেন, নাড়ি পুঁতা পুণ্যভূমিতে, এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে দম নেওয়াটাও আপনার পরিচিত মনে হবে, চারপাশের সব অচেনা মুখকেও মনে হবে আত্মার আপন। যে ট্যাক্সিতে উঠে বাড়ি যাবেন, চালকের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেবেন—বাবা রে, ওই সব দেশে মানুষ থাকে না, সব মেশিন।

মুরাদ থামে। বোঝার চেষ্টা করে, ইনাম সাহেব বিরক্ত হচ্ছে কি না। ইনাম সাহেবই বলে উঠল,

আপনার কথা যুক্তিহীন না, তবে কি বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম না পড়ালেই নয়। আর তা পড়ার পর যেহেতু এ দেশে আর ভালো অপশন থাকে না, তাই বাহিরেই পাঠাতে হয়।

জি ভাইজান, তা ঠিক। দুটো মাত্র সন্তান। তাদের তো ভালো শিক্ষা দিতেই হবে, সে তো পিতামাতার নৈতিক দায়িত্বই। কিন্তু এ পর্যন্ত অনেক দেখলাম, অনেক বাচ্চা বাহিরে পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটেলড হয়ে যায়। বাবা–মায়ের মৃত্যুসংবাদে অনেকেই দেশেও আসতে পারে না। মায়ের সন্তানের মুখ দেখার শেষ ইচ্ছেটিও পূরণ হওয়ার আগেই মা মারা যায়। মৃত্যুর আগেও না, মৃত্যুর পরেও পায় না। কবর জিয়ারত করা বা কবরের শিয়রে এসে কোনো বিদেশি ছেলেমেয়ে একটু সময় বসে থেকেছে, কেঁদেছে সচরাচর শোনা যায় না। প্রথম দু–একবার যদিও আসে, তারপর ভুলেই যাবে, দেশে বাবা–মায়ের কবর আছে।

ইনাম আলী বলেন,

কী করবেন ভাই। সবাই জেনেশুনেই তো সবকিছু করছে। ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে সব জায়গায় কম্পিটিশন থেকে ছিটকে পড়বে। এ দেশে পড়াশোনা করে কিছুই তো হয় না। চাকরির নিশ্চয়তা নাই, চলাচলে পদে পদে ভয় কখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়...নিরাপত্তা নেই...দুর্বৃত্তায়ন...

ভাইসাব, ঠিকই বলেছেন পদে পদে অনিশ্চয়তা! কিন্তু ভাই দয়া করে বলেন তো, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তারা কি এমন অধিক কিছু করে ফেলেছে বা করবে বলে আপনার মনে হয়! বরং সাধারণ মানের পড়াশোনা করা আমাদের ছেলেমেয়ের দেশে জাতির গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বাঁচছে। সেই সব আমেরিকান কেমব্রিজ সিলেবাস তো আমাদের সন্তানের জন্য শুধু সমূহ বিপদই ডেকে আনছে না, ধ্বংস করে দিচ্ছে পুরো জাতিকে। বিশাল ভয়াবহ স্খলনের দিকে জাতি আজ ক্রমশ ধাবিত।

ইনাম আলী এবারে খানিক রাগত স্বরেই বলে ওঠেন,

মুরাদ সাহেব, আপনি কিন্তু এখন একেবারে অযৌক্তিক ভিত্তিহীন সস্তা কথা বলছেন!

ভাইজান, মাফ করবেন। আমার জ্ঞান নিতান্ত সীমিত। অনুমতি পেলে সেই সীমিত জ্ঞান থেকে একটু বলি?

ইনাম আলী কোনো কিছু না বলেই ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। মনে মনে ভাবছেন, ‘হালায় বিশাল পণ্ডিত, এই সব বদমাশের জন্য দেশটা আগাতে পারে না।’

মুরাদ অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা না করেই বলতে শুরু করল,

ভাইজান, আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে পড়ছে। তাই তারা দেশীয় সংস্কৃতি কৃষ্টি কালচার, দেশপ্রেম, যুদ্ধ, স্বাধীনতা, ভাষাসংগ্রাম, বাংলার কবিসাহিত্য ভান্ডার সম্পর্কে জানছে, জানার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের আচার–ব্যবহার কিন্তু যথেষ্টই মার্জিত রুচিশীল। হয়তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের...

মুরাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনাম আলী বলেন,

তারা বেয়াদব! ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চারা আদবকেতা জানে না, সেটাই বলতে চাচ্ছেন!?

না না, ভাইজান, আমি সেটা বলছি না। বরং আমি নিজে দেখেছি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা হয়তো, আমাদের বাংলা মিডিয়ামের বাচ্চাদের থেকে আরও অনেক বেশি মার্জিত, ভদ্র, রুচিশীল, আদব কায়দায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।

হ্যাঁ, তাহলে তো ঠিকই আছে, হুদাই কেন এত কথা বলার কী আছে!

ইনাম ভাই, আমি আসলে বলছি, এসব বিদেশি সিলেবাস আমাদের যে অদৃশ্য ক্ষতি করছে, আমাদের মেধা মনন চেতনার জগতে সুপ্ত বিষ হয়ে আস্তে আস্তে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তার কথা!

কী বলতে চান, সে কেমন!!

আমেরিকা বলেন আর ব্রিটিশ বলেন, ওদের কারিকুলাম লক্ষ করেন। দেখবেন সেখান থেকে আমাদের সন্তানেরা যা পড়ছে, যা জানছে তারা যা কিছু জানছে, যা দেখছে শুনছে তার সবই তাদের চোখে, মানে, হয় ইউরোপীয় নয়তো আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে। সেগুলো আমেরিকার স্বাধীনতা, তাদের বিজয়ের গল্প। ব্রিটিশ সূর্য কখনো অস্তমিত যেত না, সেই শোষণ করা গৌরবের গল্প। তাদের সিলেবাসে এশিয়া বা উপমহাদেশীয় শিক্ষা, ইতিহাস, বিজয় স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেওয়া হবে না। ফলে আমাদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে আমেরিকান আর ইউরোপীয় কৃষ্টি কালচারকে পড়ে শিখে দেখে, লালন পালন করে বুকে ধরে। তারা জানছে তাদের যুদ্ধ গল্প, তাদের বীরত্বগাথা, তাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি। যে বিজয় আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দিক দিয়ে কোনোভাবেই গুরুত্ব রাখে না, তারা সেটিকেই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, বড় বিজয় হিসেবে জানছে। তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে অত্যাধুনিক কৃষ্টি কালচার, পার্টি ডিজে, লিভ টুগেদার, রোমাঞ্চ, উইকেন্ড, ফুর্তি—এসবে। সেটা হয়তো তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এগুলোই আমাদের মাঝে তখন সমস্যা হয়ে ওঠে, যখন আমাদের সন্তানেরা বড় হয়, সেসব বিশ্বাস করতে শুরু করে, পরিপালন করে। তারা প্রকৃত অর্থেই তো, ওয়েস্টার্ন কালচার রংচঙে, চাকচিক্য বিলাসিতা আর ভোগবাদে পরিপূর্ণ। কয়জনের তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আছে! আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য, দীক্ষা হলো—রক্ষণশীল, ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক বন্ধন, শ্রদ্ধা–সম্মান। সেখানে তাদেরটা উন্মুক্ত, আধুনিক জীবন আর বহুগামিতা। তাদের ওল্ড এজ হোম বা বৃদ্ধাশ্রম একটি নিয়মিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অথচ সেটা আমাদের সঙ্গে হলে আমরা তা মেনে নিতে পারি না। এখনো পরিবার মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দুতেই। তাদের পরিবারে কি সেটাই বুঝে ওঠার সুযোগ হয় না। বাবার গার্লফ্রেন্ড, মায়ের ডেটিং, সেপারেশন, ডিভোর্স, যৌনতা ইত্যাদি বিষয় ওয়েস্টার্ন কালচারের জন্য ডালভাত। কিন্তু আমাদের জন্য নয়, অন্তত এখনো নয়। আমার দেশে ৯৫ ভাগ ছেলেমেয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের সব প্রজন্ম রক্ষণশীলতা, ধর্মীয়, পারিবারিক মূল্যবোধ ও অনুশাসনেই বিশ্বাসী। সে শিক্ষাতেই বড় হওয়া। এখনো ছেলের ৫০ বছর বয়স হলেও—অক্ষম বিছানায় পড়ে থাকা বাবাই অভিভাবক, এখনো আমরা সেই নিস্তেজ মানুষটাকেও ভয় পাই—এটাই আমাদের সৌন্দর্য। তাদের মতো বয়স ১৮ হলো তো, তোমার জীবন তোমার—এখনো কল্পনাতেও আনতে পারি না আমরা। সবচেয়ে বড় সত্য হলো, আমাদের কালচার তাদের মতো এত আকর্ষণীয় চকচকে মোহজাগানিয়া ভোগবাদ নয়। তাই আমাদের সন্তান খুব যৌক্তিকভাবেই ওই বিদেশি কালচারে বেশি আকৃষ্ট হয়। মনেপ্রাণে তাদের মতো হয়ে উঠতে চাইবে। আমাদের কোনো কিছুতে তারা আর আনন্দ খুঁজে পাবে না। দেশীয় কালচার তাদের কাছে প্রাচীন গেঁয়ো, আটপৌরে, অনাধুনিক মনে হবে। পরিবার, সম্পর্ক, বাবা–মা ইত্যাদি ধীরে ধীরে তাদের জন্য মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আর এখানে এভাবে প্রতিমুহূর্তেই আমরা ধ্বংসের বীজ বুনে চলেছি। এই সমাজে এখন সেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া, আধুনিক কালচার বুকে ধারণ করা সন্তানেরা বড় হয়ে এসে পড়েছে। একই সঙ্গে আধুনিক এবং রক্ষণশীলতা পাশাপাশি চলতে শুরু করেছে। বিপদ তো আসবেই। বিপদ সবে শুরু। আরও আরও বহু কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত হন ভাইসাব।

মুরাদ একনিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে একটু দম নেয়। ইনাম সাহেব এতক্ষণে প্রথম ছেলেটার দিকে ভালোভাবে তাকাল। ইনামের মুখের রা বন্ধ প্রায়। মুরাদ খানিক থেমে আবার বলে,

দেখেন, আজকে চারদিকে কত অস্থিরতা। চিরকাল দেখে আসা সম্মান করা সম্পর্কে হুট করেই কত কত ভাঙন। বিবাহবিচ্ছেদ, সেপারেশন জাতীয় শব্দগুলো আজ থেকে বছর দশেক আগেও ছিল যেন নিষিদ্ধ শব্দ। সহজে কারও সামনে কেউই প্রকাশ্যে সেসব বলার কথা ভাবতেও পারত না। আর এখন...! ভাইজান, আরও একটা বিষয় ভাবেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষে প্রকৃত অর্থেই যদি পুরোদস্তুর ওয়েস্টার্ন হতো, তাহলেও ভালো লাগত। কিন্তু আমরা, এই এশিয়ান কালো মানুষেরা যতই পড়াশোনা করি, ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের কাছে চিরকাল কালো বলেই গণ্য হব। তাদের যেমন জাত্যভিমান, কখনোই তাদের অংশ হিসেবে আমাকে আপনাকে তারা নেবে না, ভাববে না। পৃথিবী হাতেনাতে তার প্রমাণও পেয়েছে। জাতি হিসেবে এশিয়ানরা তাদের কাছে যেকোনো মূল্যে অস্পৃশ্য, তাই ক্রাইস্টচার্চে, রোমে, লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলা হয়। আমেরিকার মতো দেশেও ট্রাম্পের মতো ব্যবসায়ী আধাপাগল কট্টর মানুষ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আপনি আমাদের দেশে মানুষ নিরাপদ না বলছিলেন। ভাইজান, আমাকে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশটা এখন মানুষের জন্য নিরাপদ! কোথায় কোন দেশে কস্মিনকালেও সন্ত্রাসী হামলা হবে না। মানুষ পাখির মতো মারা পড়বে না, বলতে পারেন!
নিজেকে ওয়েস্টার্ন একজন ভাবতে থাকা আমাদের ছেলেমেয়েরা একটা সময় সত্যের মুখোমুখি হয়। অভিজ্ঞতা হয়, পদে পদে হোঁচট খায়, তখন ভীষণ রকমে হতাশ হয়ে পড়ে। সেদিন নিজেদের না ঘরকা, না ঘাটকা, না ওয়েস্টার্ন না দেশি কোনো কালচারকেই আপন করতে পারবে না, নিজের বলে মনে হবে না। ফলে তারা ভুল করবে, বিপথগামী হবে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ধর্ম তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়বে।

ভাইজান, আজ হয়তো আমার কথা আপনার শুনতে খারাপ লাগল, মূল্যহীন মনে হতে পারে। কিন্তু আজ বলে রাখলাম, ১০ বছর পর একদিন আমার কথাগুলোই আপনার মনে হবে।

***

ইনাম আলী সেদিন সত্যিই সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি মুরাদের কথাগুলো। সেদিন সেখানেই কথা শেষ করে যখন পার্ক থেকে বাসায় ফিরেছিল, কয়েক দিন মনে একটু খটকামতো থাকলেও আস্তে আস্তে মুরাদই মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।

তিন মাস আগে ইংল্যান্ডপ্রবাসী ছেলেকে তার পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গেই মহা ধুমধামে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে দেওয়া হলো। বিয়ে করে ছেলে এক সপ্তাহ পর বউকেও নিয়ে গেল। তিন মাস ফুরোয়নি এখনো, আজ সকাল সকাল সেই চিঠি। ছেলের অনুমতি দেওয়াই ছিল—সব সময় চিঠি আসার সঙ্গে সঙ্গে খুলতে হবে, কি–না–কি জরুরি বিষয় থাকে।

চিঠি খুলতেই ডিভোর্স লেটার। সঙ্গে সঙ্গে ১০ বছর আগে একদিন পার্কের বেঞ্চে বসে গল্প করা মুরাদ নামের ছেলেটিকে ইনাম আলীর মনে পড়ল। ইনামের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে...

মেহেদী হাসান তামিম: লেখক, গল্পকার

আরও পড়ুন...