ভালোবাসা রং বদলায়

‘এক বছর ঘুমাব না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে, বায়ান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে পুণ্যবান হব’...

সুনীলের কবিতার বইটা বুকের নিচ থেকে সরিয়ে নিল নীরা। কাকতাল বা মিরাকেল, যা-ই হোক না কেন, সত্যি সত্যিই মেয়ের নাম নীরা রাখা নিয়ে তার মাকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি ধর্মান্ধ শ্বশুরকুলের কাছে। দমবদ্ধ সেদিনগুলোর কথা ভাবায় পাথর চাপা দিয়ে নীরা উঠে গেল ব্যালকনিতে।

সিঁদুরে মেঘ নিয়ে আজ আকাশ হালকা লালে লাল আলোয় লাজরাঙা কনে দেখায়, সেজেছে বিকেলের সঙ্গে। এমন বিকেল কেন রোজ আসে না, ভাবনাতেই বিস্ময় আসে নীরার। একচিলতে হাসি, পুরু ঠোঁটে ধরা খেতে খেতে মিলিয়ে যায়। আহা, আনোয়ার! কেন এতটা দেরি করছ, আজ? কিছু বিকেলে, পাশাপাশি, চুপচাপ বসে থেকেও ভালোবাসি বলা হয়ে যায়।

হাতখোঁপায় চুল বেঁধে, কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই মনে পড়ে, আজ চৈত্রসংক্রান্তি। কাঁচা আম আর তেঁতুলের একটা যুগলবন্দী ভর্তার কথা ভাবতেই প্রথম দেখার দিনের স্মৃতিতে কাঁপিয়ে যায় মনজুড়ে।

এমন বিকেলে, চৈত্রসংক্রান্তির মেলায়, দেখা হয়েছিল পৃথিবীর কোনো এক মানব ও মানবীর। পরনে আসমানি নীল সাদার মায়া রং, খোঁপায় কাঁঠালিচাঁপা, দুহাতভর্তি লাল-বাসন্তী কাচের চুড়িতে দিগ্‌বিদিক ভুলিয়ে হেঁটে চলেছিল নীরা। যে করেই হোক, একদম সামনে থেকে প্রিয়তার নাচের ছবি তুলে নিতে হবে। নইলে আজ আর রক্ষে থাকবে না, প্রিয় বান্ধবীর কাছে।

মুগ্ধ বিস্ময়ে চারপাশে তরুণদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া নীরার সেই ২২ বছরের বুকের মাঝে সুর বাজছিল। গম–রঙের মেয়েটি, মুখে হাসি আনে। সবার দিকেই যদি তাকাল, তো আর উত্তম পুরুষের খোঁজ কেমন করে পাবে নীরা? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ে। কোথা থেকে যেন ভিড়ের মাঝে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ ছুঁয়ে যেতে থাকে তাকে। পেছন ঘুরে কিছু বলার আগেই প্রচণ্ড হুংকারে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে নীরার। এ কেমন যেন একটা ঘোর লাগা স্বর। তাতে শাসন আছে, শক্তি আছে। পিছু ফিরে অসভ্য, ইতর পশুটাকে দেখার আগেই বলিষ্ঠ দুটো হাত তাকে সম্মানের সঙ্গে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে। পেছন ফিরে ভিড়ের মাঝে দেখার অবকাশ পায় না নীরা। এগিয়ে যাওয়ার মাঝে একটা নির্ভরতার অনুভূতি ঘিরে ধরে রাখে তাকে বাকিটা সময়।

ভিড় ঠেলে হালকা হওয়ার পরই যেন দেবদূতের মতো সামনে আসে আনোয়ার। একমাথা চুল ছোট করে কাটা, তাতে হাত ডুববে না। ঋজু, পাথরে খোদাই মুখ, কিন্তু তাতেই অদ্ভুত এক সরলতা, শিশুর মতো খেলা করে। কালো রঙে আলো জ্বালিয়ে প্রত্যয়ী এক সবল শক্ত নির্লোভ পুরুষ দাঁড়িয়ে সমুখে। চোখ দুটো যেন জ্বলছে, অথচ কী গভীর, শান্ত দৃষ্টি নিয়ে আনোয়ার এক লহমায় নীরার সমগ্রটা দেখে নেয়।

একরাশ ভালো লাগায় মন হারায় নীরা। এমন তো আগে কখনো হয়নি মেয়েটার। ধন্যবাদ দিতে গিয়েও গলার কাঁপুনি ঢাকতে পারে না নীরা। আনোয়ার শান্ত স্বরে নাম বলে যায়। সহজ নাম, কোনো আধুনিকতা নেই, তবু কেন বুকের মধ্য এই নামটাই ধ্বনিত হতে থাকে নীরার। কোথায় যাবেন? উত্তরে মঞ্চ দেখায় সে।

এক হাতভর্তি লালচে বসন্ত আনোয়ারের মনে শেষ চৈত্রের বিকেলে পলাশরাঙা, প্রথম প্রেমের ফাগুন নামায়। রিনিঝিনি শব্দ, বুকের ভেতর চিরে যেতে যেতে তির হয়ে বেঁধে। চুপ করে দেখে যায় এক অপরূপ মুখশ্রীর মানবীকে। যাকে পাওয়ার জন্য এক জন্ম প্রতীক্ষা করা যায়। বুকের মধ্যাকাশে আজাদ এসে জমে।

‘আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি-শত্রুর জন্যও অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্য অপেক্ষায় থেকেছি—
কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকব না,
প্রতীক্ষা করব।
প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্য খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ -দু’টির তেমন কোনো আলাদা মানে নেই
কিন্তু আমরা দু’জন জানি ওই দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন, অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্য প্রতীক্ষা করব না?’ (প্রতীক্ষা, রফিক আজাদ)

নীরার যেন কেমন এক ঘোর লাগে। সামলে যেতে যেতে অস্ফুট স্বরে সে তার গন্তব্যের পথ দেখায়। ধন্যবাদ জানায়। প্রত্যুত্তরে আনোয়ার নিজের পরিচয়জ্ঞাপক শক্ত কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। আর সেই শুরু। বাড়ি ফিরে আয়নায় মুখ ঝাপটে দেওয়া পানির পর সম্মুখ অবয়বে নীরা তার স্বপ্নপুরুষ দেখে। একবুক চাপা উত্তেজনা নিয়ে রাত আসে। নীলচে আলোয় কালো রাত্তিরে নীরা হাত ঘোরায় মোবাইলে। ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে একরাশ লজ্জা ভর করে যায় কণ্ঠে।

চুপচাপ শুনে যায় আনোয়ার। যত চুপ শোনে, তার থেকে ও বেশি জোরে বলে যায় বুকের ভেতর তোলপাড় করে চলা ভালোবাসার পঙ্‌ক্তিমালা। গভীর জলে কাঁপন তোলা ঢেউ নিয়ে নীরা শোনে। নীরার মন কাঁপে, শরীরে এক অবশতা ঘিরে ধরে যায়। তবু কান পেতে শুনে চলে স্বর, গমগমে মাধুর্য নিয়ে অপর প্রান্তের স্বপ্নপুরুষকে।

তারপর কিছুদিন খোলা আকাশের নিচে কখনো চায়ের দোকানে অথবা ভরসন্ধ্যায় দুটো কপোত–কপোতী তাদের প্রেমের আখ্যান রচে কল্পনায়, বাস্তবে। একটু পাশে বসা, হাত ধরাতেও শত আপত্তি নিয়ে ভেবে চলা নীরার, মাঝেমধ্যে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার সাধ জাগে। আনোয়ার কী কঠিন কাঠিন্যে নিজেকে ঢেকে চলে অবিরাম। যা নিজের, তাকে যোগ্য করে, আপন আলোয় পাওয়ার মতো প্রেমিক পুরুষ মনে হয় তাকে।

কোনো এক পারিবারিক দুপুরে এক ছাদের নিচে ঘর বাঁধা হয়ে যায় তাদের। সামরিক জীবনের বেপরোয়া ছেলেটা, স্বাচ্ছন্দ্যে প্রেয়সীর ভাঁজ খোলে, আলতা পরায়। সযতনে আগলে রাখে সেই বিকেলের মতন।

পুরোনো স্মৃতি ভেবে ভেবে একটা সময় নীরা মাপে মাপ, চায়ে পাতা ঢালে। বলকে যে ঢেউ ওঠে, তেমন ঢেউ তার বুকে জাগে। কতটা সময় যায়, মানুষটা কেন আসে না আজ? মোবাইলটাও জানায় না কিছু। বরং একটানা বেজে বন্ধ হয়ে যায়।

চায়ের সুবাস ছড়ায়, গরম তেলে পাঁপড়ের সঙ্গে দুশ্চিন্তাগুলো সরিয়ে তেলে ফেলে ভেজে নিতে চায় নীরা। একটা কেমন ভয় ধরে মাগরিবের আজানের সঙ্গে নিজেকে সঁপে সৃষ্টিকর্তার কাছে। আনোয়ারের জন্য দুলে দুলে মোনাজাত করে সে। বিয়ের তিনটি বছরে, সব অভিযোগ তুলে নেয় সে, বিনিময়ে স্বামীর নিরাপদ জীবন চায় বারবার।

‘তুমি এখানে? আর আমি বারান্দা খুঁজে এলাম।’ নাও কাঁঠালিচাঁপা, এদিকে এসো, পরিয়ে দিই! দূরে এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? আনোয়ারের ডাকে, একছুটে দৌড়ে আসে মেয়েটা। মুখ লুকায় বুকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কেন ফোন ধরোনি? দেরি হলো কেন? একের পর এক উৎকণ্ঠার প্রশ্নের সঙ্গে অভিমানী হয় নীরা।

শক্ত করে বুকে চেপে পাগলি বউয়ের অনুযোগ শোনে আনোয়ার। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানায়, আর তার সঙ্গে মুখ চুম্বনে থামায় অভিমানীকে।

পৃথিবী এক পাশে থাকে, ঘামে ভেজা আনোয়ারের বুকের সঙ্গে মিশে যেতে যেতে নীরার দুচোখ ভরে জল আসে। ভালোবাসা একই থাকে। শুধু সময়ে সময়ে তার রং বদলে, মজবুত হয়, নির্ভরতা বাড়ায়।

থাকুক তারা কিছুক্ষণ এমন, বাইরে ঝোড়ো বাতাস নিয়ে ঝড় নামে। পৃথিবীর দুজন মানুষ শুধু একে অপরের মাঝে ভালোবাসায় ডুবে যেতে থাকে। ভালোবাসার ঝড়ে তুমুল প্রেমে তারা নিজেদের রাঙিয়ে যায়।

তুমি তুমিই আছ, আমিও তেমন, শুধু ভাবি
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, একটু ছাইয়ের মতো বুঝি হালকা পরত জমেছে বুকে।
দৈনন্দিন সব নিয়মের মাঝে, সকাল, দুপুর, বিকেল
নিয়ম করে ভালোবাসি বলি না এখন।

গার্হস্থ্যের ছন্দগুলো, ঠিক ঠিক প্রেমগুলোকে
নিজেদের রূপে সাজায়
আমি তুমি সাজপোশাক বদলের মতো
রোজ একেক রূপে সাজি
তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে বুঝি, ঠোঁটের মাঝে ঠোঁট,
পরতে পরতে প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে মাখি গায়
এই দেখো, ভালোবাসাগুলো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়।

* সুরভী হাসনীন, উত্তর কাফরুল, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।