নারীর নীরব কান্না আর কত?

রিনার (ছদ্ম নাম) সুখ দেখে মা-বাবা খুব গর্ব করে বলেন, সবুজের (ছদ্ম নাম) মতো মেয়েজামাই পাওয়া মুখের কথা নয়। অন্যদিকে বন্ধু মহলে রিনা অনেকের কাছে ঈর্ষার পাত্রী। নিত্যনতুন সাজে রিনাকে সব ধরনের বিলাসী জীবন দিয়েছেন সবুজ। এসব কিছু রিনা–সবুজের দাম্পত্য জীবনের বাহ্যিক রূপ।

১৮ বছর ধরে রিনা চাবি দেওয়া পুতুলের মতো সবুজের সংসারের সবকিছু করে যাচ্ছেন। সবুজের চাওয়া–পাওয়াতে রিনাকে মানিয়ে নিতে হয়। কারণ, বিয়ের পর স্বামী সংসারের মাঝেই মেয়েদের ‘অস্তিত্ব’, হোক না তিনি যতই শিক্ষিত, মেধাবী।

নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মজগতে প্রবেশ করতে পারেননি রিনা। যদিও খাতা–কলমে তিনি সবুজের ব্যবসার একজন পরিচালক। কিন্তু কোনো বোর্ড মিটিংয়ে তাঁর কিছু বলার অধিকার নেই। স্বামী পয়সার বদৌলতে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে সভা–সেমিনারে নারীর স্বাধীনতা, অধিকার, স্বাবলম্বী হতে হবে এসব নিয়ে কত কিছু বলেন। তবে তাঁর স্বাধীনতার চাবিটা সবুজের কাছে বন্দী। মাঝে মনে হয় সুখী সুখী ভাব নিয়ে যে নির্যাতিত নারীদের জন্য কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর তফাতটা কোথায়? আসলে রং মাখা মিথ্যা পরিবার, সমাজ আর সম্পর্কগুলো তাঁর পায়ের শিকল।

তাই দিন শেষে এক ছাদের তলায় বাস করা দুজন মানুষের গল্পটা হয়ে যায় এ সমাজের হাজারো গৃহ নির্যাতনের শিকার নারীর মতো। সবুজের শারীরিক–মানসিক চাহিদার কাছে রিনার নিজের ভালো লাগা–মন্দ লাগার কোনো মূল্য নেই। আর এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে যে কালশিটে দাগ শরীরে পড়ে, তা দিনের আলোতে ঢাকা পড়ে যায় দামি পোশাকের আড়ালে। চোখের জল মনের কান্না হয়ে থাকে কাজলটানা চোখের কালিতে।

রিনার মতো নারীর সংখ্যা আমাদের সমাজে নেহাত কম নয়। যাঁরা নীরবে চোখের জল ফেলে যান কেবল। কারণ পরিবার, সামাজিক অবস্থানের কারণে তাঁরা নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন না। এককথায় বলা যায়, ‘নিজেকে বলিদান করেন সো কলড সোশ্যাল স্ট্যাটাসের কাছে।’

এ দেশের নারীরা যখন ধর্ষণের শিকার হন কিংবা স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে জীবন দেন, তখন চারদিকে বিচারের দাবি ওঠে। কিন্তু দিনের পর দিন রিনার মতো যাঁরা নির্যাতিত হন, তাঁদের জন্য কোনো আইন নেই, নেই কোনো সামাজিক বিচার। শুধু একটি কথা সবাই বলেন, ‘মেনে নাও, সংসার করতে গেলে স্বামীর কথা শুনতে হয়।’

যুগ অনেক এগিয়ে গেছে। নারী-পুরুষের সমঅধিকার এখন। মেধা দিয়ে নারী প্রমাণ করছেন তাঁরা পিছিয়ে পড়া সমাজের অংশ নন আর।

এত কিছুর পরও শুধু পরিবর্তন আসেনি নারীর ওপর পুরুষের ক্ষমতা বিস্তারের মানসিকতাতে।

শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও ভয়ংকর মানসিক নির্যাতন। আর এ মানসিক নির্যাতনের প্রতিবাদে রিনার মতো নারীরা শিকার হন শারীরিক নির্যাতনের। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের সাহস–শক্তি ক্রমেই হারিয়ে ফেলেন। শুধু নিজের কণ্ঠরোধ করা কান্নাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছেন আর বেঁচে থাকবেন কতকাল, তা কেউ জানেন না।

কারণ, এমন নির্যাতনের প্রতিকার তত দিন আসবে না, যত দিন না সবুজের মতো পুরুষেরা নারীকে চাবি দেওয়া পুতুল নয় বরং মানুষ মনে করবেন।

* হাসিনা আকতার নিগার: লেখক ও কলামিস্ট