জাদুঘরের শহর কুমারখালী

কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত
কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জনপদ কুমারখালী উপজেলা। কুষ্টিয়ার বেশির ভাগ ঐতিহ্য কুমারখালী উপজেলাকে ঘিরেই। এ জন্য কুমারখালীকে বলা হয় ‘শিল্প শহর’। ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে কুমারখালী পাবনার অন্তর্ভুক্ত হয়। এর আগে প্রাচীন জেলা যশোরের মধ্যে ছিল। ১৮৫৭ সালে কুমারখালীতে মহকুমা প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় কুমারখালী মহকুমার অধীনে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি, পাংশা, কুমারখালী, খোকসা ও অধুনালুপ্ত ভালুকা থানা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৭১ সালে কুমারখালী মহকুমা বিলুপ্ত হয়ে থানা হিসেবে নবগঠিত কুষ্টিয়া মহকুমা অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়া জেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। অন্যদিকে ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমারখালী পৌরসভা। প্রাচীন ইতিহাসখ্যাত জনপদ কুমারখালী এখনো তাঁতশিল্পে সমৃদ্ধ উপজেলা। কুমারখালী উপজেলার উত্তরে পদ্মা, মধ্যখানে আঁকাবাঁকা ঐতিহ্যবাহী গড়াই নদ।

পলাশী থেকে মুজিবনগর, একাত্তর থেকে অদ্যাবধি বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম ও ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে আসছে কুমারখালী। কুমারখালীর মাটি ও মানুষ ধন্য হয়েছে সাঁইজি লালন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকগানের শিল্পী গগন হরকরা, শক্তিমান গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন, সাংবাদিক ও সমাজসংস্কারক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, সাহিত্যিক শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবসহ অগণিত গুণী মানুষের জন্ম এবং পদচারণ। স্মৃতির সমারোহে এই শহর এখন বাংলাদেশের একমাত্র মিউজিয়ামের শহর হিসেবে পরিচিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মাঝেও একই উপজেলায় চারটি মিউজিয়াম নিয়ে কুমারখালী উপজেলার ইতিহাস এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে।

প্রায় ২৮ শতক জমির ওপর নির্মিত হয়েছে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত
প্রায় ২৮ শতক জমির ওপর নির্মিত হয়েছে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

নান্দনিক শৈল্পিক নিদর্শন কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু হয় ১৮৯৬ সালে। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সমাজসংস্কারক এবং বাউল গানের রচয়িতা। গত সরকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পে প্রায় ২৮ শতক জমির ওপর নির্মিত হয়েছে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত হয়েছে জাদুঘরটি। ব্যতিক্রমধর্মী এই জাদুঘরে প্রবেশমুখে চোখে পড়বে রঙিন ইটপাথরের সুন্দর কারুকাজ। মাঝখানেই কাঙাল হরিনাথের ভাস্কর্য। অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে ফুলের বাগান। বিভিন্ন ফুলের সমাহারে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে; বিশেষ করে দর্শনার্থীদের কাছে। কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে সেলফি আর ছবি তোলার পর্বে বাড়তি সৌন্দর্য এনে দিয়েছে ফুলের বাগান। নিচতলায় রয়েছে ১০০ আসনবিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক সম্মেলনকক্ষ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই দেখতে পাওয়া যাবে কাঙাল হরিনাথের ছবি, গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার অবয়বসহ বিভিন্ন বিষয়ের ১৬৮টি নিদর্শন। এর মধ্যে ৬৭টি ছবি। ছবির ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে কাঙাল হরিনাথের বিভিন্ন স্মৃতির নিদর্শন। বের হয়ে আসতেই সামনের খালি জায়গা রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য। দোতলার উত্তর পাশে সুন্দর পাঠকক্ষ ও লাইব্রেরি। আছে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩০০ বই। বইগুলো পড়ার জন্য সুব্যবস্থাও আছে। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বাদে ছয় দিনই খোলা থাকে। শুধু শুক্রবার বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ৮টা এবং অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত সবার জন্য। দৃষ্টিনন্দন জাদুঘর হিসেবে ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে দর্শনার্থীদের কাছে।

জাদুঘর থেকে মিনিট পাঁচেক পশ্চিমে হাঁটলেই কাঙাল কুটির। যেখানে এখনো রয়েছে কাঙালের সেই বিখ্যাত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছাপার ‘এমএন প্রেস’, যা ইতিহাসে গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত প্রথম ছাপাখানা হিসেবে পরিচিত। এখান থেকেই তিনি প্রকাশ করতেন পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার বেঁচে নেই। কিন্তু আছে তাঁর ঐতিহ্যবাহী ‘এমএন প্রেস’। সর্বশেষ হরিনাথের প্রপৌত্র অশোক মুজমদার এটির দেখাশোনা করতেন। অশোক মজুমদার মৃত্যুবরণ করলে এখন তাঁর স্ত্রী, সন্তান দেখাশোনা করছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এই ছাপাখানার ওপর বোমা নিক্ষেপ করলে অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এখনো বাইরে থেকে আসা দর্শনার্থীদের ঘুরেফিরে দেখান প্রেসটি।

কালী নদীর পাশেই সাঁইজি লালনের আখড়াবাড়ি। ছবি: সংগৃহীত
কালী নদীর পাশেই সাঁইজি লালনের আখড়াবাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

লালনের আখড়াবাড়ি
কুমারখালী উপজেলার কালী নদীর পাশেই রয়েছে সাঁইজি লালনের আখড়াবাড়ি। মানবতাবাদী দার্শনিক ছিলেন সাঁইজি লালন। ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত ভেদকে উপেক্ষা করে তিনি গেয়েছেন মানবতার গান। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে আসা শত শত মানুষের ভিড় লেগে থাকে। বছরে দুবার বৃহৎ পরিসরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির আয়োজনে লালনের মৃত্যুবার্ষিকী ও দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সাঁইজির ভক্তরা প্রতিদিনই আখড়াবাড়িতে গানের আসর বসান। রয়েছে লালন জাদুঘর ও সংগ্রহশালা এবং গবেষণাকেন্দ্র। গান শেখা ও চর্চার জন্য সংগীত বিদ্যালয়। গাছগাছালি আর ফুল ফলে ভরা মনোরম পরিবেশ। আরও রয়েছে লালন অডিটোরিয়াম, লালন মঞ্চ ও লালনের ভাস্কর্য। সাঁইজির মাজার ছাড়াও রয়েছে তাঁর ভক্তদের সমাধিস্থল। সংগ্রহ করতে পারবেন লালনবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ, মৃৎশিল্প ও খোদাই করা শৈল্পিক কারুকার্য এবং একতারাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। সাঁইজি লালনের আখড়াবাড়ি এখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা
আয়তনে কুমারখালী উপজেলার মধ্যে হলেও কুষ্টিয়া শহর এবং সাঁইজি লালনের আখড়াবাড়ি থেকে একটু দূরে গড়াই নদের পাশে রয়েছে বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনর বাস্তুভিটা। সরকারিভাবে নির্মিত হয়েছে মীর মশাররফ হোসেন লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা ও অডিটোরিয়াম। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও দেখতে পাওয়া যাবে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছু। বিষাদসিন্ধু তাঁর অমর সৃষ্টি। মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনীপাড়া গ্রামে মীর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটনকেন্দ্র কুমারখালীর শিলাইদহ। দক্ষিণে গড়াই, উত্তরে পদ্মা নদীর অপর পারে পাবনা শহরের বিপরীতে এর অবস্থান। শিলাইদহ নামটি আধুনিক। আগে স্থানটি খোরশেদপুর গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার এই গ্রামটি কিনে নেওয়ার আগে এখানে একটি নীলকুঠি ছিল। শেলী নামের একজন নীলকর এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। গড়াই এবং পদ্মা নদীর মিলিত প্রবাহের ফলে সৃষ্ট গভীর একটি ‘দহ’ থেকে গ্রামটি শেলীদহ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। কালক্রমে তা শিলাইদহতে পরিণত হয়। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইলসূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এই জমিদারির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে এক দশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ অনিয়মিতভাবে এখানে অবস্থান করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানকালে নানা উপলক্ষে শিলাইদহে এসেছিলেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদারসহ তৎকালীন বঙ্গের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। এই কুঠিবাড়ি ও পদ্মার বোটে বসেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘ক্ষণিকা’, ‘নৈবেদ্য’ ও ‘খেয়া’র অধিকাংশ কবিতা, পদ্মা পারের গল্প, নাটক, উপন্যাস, পত্রাবলী ও ‘গীতাঞ্জলি’ এবং ‘গীতিমাল্যের’ গান। আবহমান গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা শিলাইদহ ও পদ্মার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অনুরাগ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা-প্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে।’

শিলাইদহ কুঠিবাড়ি আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য চিরসবুজ বৃক্ষের বাগান, একটি পুষ্পোদ্যান, দুটি পুকুরসহ প্রায় ১১ একর মনোরম এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। শিলাইদহে রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ আর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দক্ষিণ দিকে অবস্থিত অতি সাধারণ অথচ আকর্ষণীয় প্রবেশ তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায়। কুঠিবাড়ি ভবনটি একটি বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নিচতলা ও দোতলায় বিভিন্ন আকারের মোট ১৫টি কক্ষ রয়েছে। উন্মুক্ত ব্যালকনিগুলো রানীগঞ্জ টালি দিয়ে তৈরি ঢালু ছাদ দ্বারা আংশিক আচ্ছাদিত। নিচতলার ওপরের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে ত্রিকোণ প্রান্তবিশিষ্ট একটি ঢালু ছাদ। দোতলার ওপরের পিরামিড আকৃতির ছাদ ভবনটি আরও বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে সৌন্দর্যকে। বর্তমানে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত একটি জাতীয় ইমারত। সরকারি উদ্যোগে এখানে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শিলাইদহের কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রভক্তদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ জাতীয় পর্যায়ে কবির জন্মবার্ষিকী ও ২২ শ্রাবণ বিশ্বকবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ও শিল্পী, কবি রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মভিত্তিক আলোচনা এবং সংগীত পরিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪১ সালে কলকাতার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

ইমাম মেহেদী: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]