কালের সাক্ষী হোটেল শাহবাগ

হোটেল শাহবাগ নির্মাণের পূর্বে প্রকল্পটির মডেলসহ ১৯৫১ সালে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ
হোটেল শাহবাগ নির্মাণের পূর্বে প্রকল্পটির মডেলসহ ১৯৫১ সালে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ

দেশভাগের পর বিদেশি অতিথিদের আবাসন ও খাওয়া এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বড় আকারের অভ্যর্থনার জন্য ঢাকায় একটি অভিজাত আবাসিক হোটেল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে তিন তারকা মানের একটি আন্তর্জাতিক হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। নিযুক্ত হয় বিদেশি স্থপতি ও নকশাবিদ। পাশাপাশি সম্পৃক্ত করা হয় স্বনামধন্য সব ঠিকাদার। হোটেলটির অবস্থান ছিল শাহবাগ মোড়ে। বর্তমানে যে স্থানে পূবালী ব্যাংকের অবস্থান, ঠিক এর পেছনেই।

নির্মাণাধীন হোটেল শাহবাগের একটি চিত্র পাওয়া যায় ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ১ এপ্রিল, ১৯৫২ সংখ্যায়। ‘সরকারী শাহী হোটেল’ শিরোনামে বর্ণনাটি ছিল এরকম — “রমনা ঘোড়-দৌড়ের মাঠের নিকট এক বছরের অধিক হলো একটি সুবৃহৎ বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। এই দালানটির কাজ সম্পূর্ণ হলে এটি হবে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ হোটেল। এক লাখ তেইশ হাজার এক শ চব্বিশ বর্গফুট স্থানব্যাপী এই হোটেলটি তৈরি হচ্ছে। চারতলা বিশিষ্ট এই হোটেলে একটি লোকের বাসযোগ্য ১৩ ফুট ৪ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ১২ ফুট প্রস্থ ৭১টি এবং দু’জনের বাসযোগ্য ১৫ ফুট দীর্ঘ ও ১৩ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রস্থ ২৬টি কামরা থাকবে। তা’ছাড়া, এ সমস্ত কামরায় মোট ১৪৩ জন বাস করতে পারবে। ... প্রত্যেক কামরার সঙ্গে যুক্ত থাকবে একটি করে ভিজিটিং রুম। ... চারতলা অট্টালিকার দক্ষিণ পূর্ব দিকে আরও একতলা বাড়ানো হবে এবং তাতে অতি আধুনিক ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রণালীর রন্ধনশালা থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে একটি সুন্দর পুষ্পোদ্যান। দুই, তিন ও চারতলায় শুধু বাসস্থানই থাকবে। নিচের তলায় থাকবে লাইব্রেরি, লাউঞ্জ, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, ব্যাংকুয়েট হল এবং প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ ও ৪০ ফুট প্রস্থ একটি ভোজনাগার।.......দালানটি তৈরী করতে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয় হবে। আসছে বছরের প্রথম দিকে এর উদ্বোধন হবে এমন আশা করা যায়।”

১৯৫৫ সালে হোটেল শাহবাগ। ছবি: সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম
১৯৫৫ সালে হোটেল শাহবাগ। ছবি: সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম

ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে হোটেল শাহবাগের বহুমাত্রিক ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর শুভ মহরত অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই হোটেলে। অস্কার জয়ী ছবি ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’-কে ঘিরেও রয়েছে হোটেল শাহবাগের স্মৃতি। ১৯৫৫ সালে চিত্রায়িত এই ছবির শুটিং হয়েছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে। পুরো ইউনিটের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল হোটেল শাহবাগে। একদিকে মিন্টো রোড জুড়ে ব্রিটিশ আমলের লাল ইটের বাংলো; অন্যদিকে রমনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সবুজ বৃক্ষরাজি ও লেক, ঘোড়দৌড় ও গলফ খেলার মাঠ, পার্শ্ববর্তী ঢাকা ক্লাব— সব মিলিয়ে বিদেশি অতিথিদের জন্য হোটেল শাহবাগ ছিল অনিন্দ্যসুন্দর এক স্থান।

ষাটের দশকে সড়ক সম্মুখস্থ ফোয়ারাসহ হোটেল শাহবাগ। ছবি: সংগৃহীত
ষাটের দশকে সড়ক সম্মুখস্থ ফোয়ারাসহ হোটেল শাহবাগ। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ, ‘উতল রোমন্থনঃ পূর্ণতার সেই বছরগুলো’-তে আলোচিত হয়েছে হোটেল শাহবাগ ও বঙ্গবন্ধুর কথা। ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই মওলানা ভাসানী কর্তৃক তৎকালীন বামপন্থী দলগুলোর এক সমাবেশের আয়োজন করা হয় রূপমহল সিনেমা হলে। সেখানে পাঞ্জাবের বামপন্থী নেতা মিঁঞা ইফতেখারুদ্দীন উপস্থিত হতে না হতেই বিরোধী সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হন। ট্যাক্সিচালকের বুদ্ধিমত্তায় সে যাত্রায় রক্ষা পান। তিনি ঢাকায় এসে উঠেছিলেন হোটেল শাহবাগে। অগত্যা সেখানেই ফিরে যান। রেহমান সোবহান, আহত মিঁঞা সাহেবকে হোটেল শাহবাগে দেখতে গেলে সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। নিজ সমর্থকদের আক্রমণের শিকার বিরোধী দলীয় নেতা মিঁঞাকে দেখতে বঙ্গবন্ধু সেখানে গিয়েছিলেন!

বিবিধ সেবা গ্রহণের বিনিময় মূল্যসহ হোটেল শাহবাগের বিজ্ঞাপন। ডন পত্রিকা, ৩১ মার্চ, ১৯৬৮।
বিবিধ সেবা গ্রহণের বিনিময় মূল্যসহ হোটেল শাহবাগের বিজ্ঞাপন। ডন পত্রিকা, ৩১ মার্চ, ১৯৬৮।

১৯৬৪ সালের শেষ দিকে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার উদ্বোধন করা হয়েছিল হোটেল শাহবাগে। নগরের সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালীদের বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান হতো এখানে। ১৯৬৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহানের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে হোটেল শাহবাগে। শুধু বিলাস-ব্যাসনই নয়, উর্দু ও বাংলা কবিতা পাঠের আসরেও খ্যাত হয়েছে হোটেল শাহবাগ।

কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী ‘আমার কণ্ঠস্বর’ হতে জানা যায়, ১৯৬৮ সালের ৩১ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মুশায়েরা (উর্দু কবিতা)-র জমজমাট আয়োজন করা হয়। সেখানে এসেছিলেন প্রখ্যাত উর্দু কবি যোশ মালিহাবাদী, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমদ নদীম কাজমী, কাতিল শিফাই প্রমুখ। বাঙালি কবিদের মধ্যে ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন এবং বেগম সুফিয়া কামাল। পূর্ব পাকিস্তানের লেখকদের অধিকাংশই এই অনুষ্ঠানের খবর জানতেন না। ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের লেখক সংঘের উদ্যোগে একই বছরের ১৯ মে পাল্টাপাল্টি মনোরম এক কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। আর সেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল হোটেল শাহবাগের ব্যাংকুয়েট হলে। কবি হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন এর উদ্যোক্তা। এই আসরে স্বরচিত কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন কবি জসীম উদ্দীন, আবদুল কাদির, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, জাহানারা আরজু, শহীদ কাদরী প্রমুখ।

হোটেল শাহবাগের কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ ঘোষণা। ছবি: বাংলা দৈনিক পত্রিকা, জুন ১৯৭১
হোটেল শাহবাগের কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ ঘোষণা। ছবি: বাংলা দৈনিক পত্রিকা, জুন ১৯৭১

১৯৬৫ সালে হোটেল শাহবাগের এই ভবনটি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগৃহীত হওয়ার পরও হোটেল শাহবাগের কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৪ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় হোটেল শাহবাগ এবং ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর)-এর কার্যক্রম শুরু হয়। জনমানুষের নিকট যা পিজি হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত পায়। পরে এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হয়।

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ