শুভ জন্মদিন: রাজনীতির দুরন্তপনা ও গণমানুষের তাজউদ্দীন

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ

প্রথম শ্রেণিতেই প্রথম হয়ে সাড়ে আট পয়সার একটি কলম আর দেড় পয়সার কালির দোয়াত পেয়েছিল যে বালক, তার ছাত্রজীবনের বলিষ্ঠ ফলাফল বুঝতে এমন সূচনাই যথার্থ। মানববিজ্ঞান, ধর্মবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের এক দারুণ সমন্বয়ে তৈরি হওয়া বালক তাজউদ্দীন আহমদ (২৩ জুলাই ১৯২৫-৩ নভেম্বর ১৯৭৫) ছিলেন পবিত্র কোরআনে হাফেজ। পাশাপাশি অর্জন করেছেন সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির জ্ঞান। পিপাসু মন এবং কৌতূহলী মস্তিষ্ক বালক তাজউদ্দীনকে তাড়িত করত জ্ঞান অর্জনের জন্য। স্নাতক পর্যায়ে অর্থনীতি এবং আইন শাস্ত্র আয়ত্ত করায় স্কুল জীবন থেকে লালন করা রাজনীতির বাসনা তথা মানুষের মুক্তির পথের ঠিকানা খোঁজাই তাঁর জন্য হয়ে ওঠে অবধারিত। মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক ভাগ্যকে নিজেই পরিচালনায় তিনি বিশ্বাস করতেন।

ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলন আর সংগ্রামে উত্তাল দিন কাটিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। শঙ্কাহীন নেতৃত্বের বাঁধনে পুরো ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেছেন ৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২-র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী জীবনেও যাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে তরুণদের জন্য এক উদাহরণ হয়ে আছে। সক্রিয় রাজনীতি কখন তাঁর জীবনে প্রবেশ করে, তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা মুশকিল। কারণ, কার্যত একজন নেতার জন্ম হয় রাজনীতি করার জন্য। সুস্পষ্ট নেতা হয়ে ওঠা তাজউদ্দীন আহমদ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সম্পূর্ণ গণমানুষের তাজউদ্দীন। রাজনীতির সুন্দর বাঁধনে তার ছাত্রজীবন ব্যাহত হয়েছে সত্য, তবে থেমে থাকেনি মোটেই। জেলে থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন, স্নাতক পাস করেছেন আইন বিষয়ে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়া অবস্থায় বন্ধু, বড় ভাইদের সঙ্গে চলত তাঁর রাজনীতির আলোচনা। যুক্তি আর ব্যাখ্যা প্রদর্শনে তাঁর কাছাকাছি আসাটা দুরূহ ছিল।

পরোপকারী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর মহানুভবতার চর্চা করতেন ছাত্র অবস্থা থেকেই। ছাত্রাবাসে গরিব মানুষের জন্য তাঁর ভাবনা, অন্য সহকর্মীদের উৎসাহ জোগানো ছিল তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। কথাচ্ছলে তিনি বলতেন, ‘অর্থনীতি নিয়েছি এই জন্য যে মানুষের উন্নতি করব বলে।’ পড়াশোনাকে শুধু পুঁজিবাদী ক্যারিয়ারের লক্ষ্য করে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়ন ছিল না। বরং বর্তমান ছাত্রসমাজ যে ভয়ংকর পথে অগ্রসর হচ্ছে, তার বিষাক্ত ফলাফল থেকে মুক্তি পেতে যে আদর্শ প্রয়োজন, ঠিক তা-ই ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলতেন, ‘শিক্ষা গ্রহণ করে যদি আমরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে না পারি, সে শিক্ষার কোনো মূল্য নেই।’ ব্যক্তিগতভাবে তিনি সব মানুষের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন, যা তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। ছাত্রজীবনে দরিদ্র ছাত্রের ফি মওকুফ করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রজীবনেও তিনি তাঁর ক্ষমতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনায় ব্রত ছিলেন। কাছের আত্মীয় কিংবা নিজ দলের কেউ হলেও তাঁকে অগ্রাধিকার কিংবা ন্যূনতম অন্যায় কোনো আবদারের প্রশ্রয় তিনি দেননি ।

নেতৃত্বর ওপর জনসাধারণের আস্থা তৈরি হওয়ার মূল ভিত্তি হলো তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্র। তাজউদ্দীন আহমদের নৈতিক চরিত্রের বলে তাঁর কোনো অর্থনৈতিক হেরফের কোনো দিন কেউ দেখাতে পারেনি। স্কুলে থাকাকালীন তৎকালীন বলিষ্ঠ নেতাদের দৃষ্টিতে পড়েছিলেন তেজদীপ্ত বালক তাজউদ্দীন আহমদ। স্কুলের এক শিক্ষকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাজউদ্দীনকে সেই শিক্ষক বলেছিলেন, ‘আমি হেডমাস্টার হলে তোমাকে বহিষ্কার করে দিতাম।’ প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ জন্যই আপনি হেডমাস্টার হননি।’ অন্যায়ের প্রতি এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠ তিনি চর্চা করেছেন ছোটবেলা থেকেই।

সমাজে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে এখনো বহু মানুষ আছেন যাঁদের কেউই মৌলিক রাজনীতি পাঠের গণ্ডি শেষ করতে পারেননি। বিপরীতে, অনেকেই আবার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া রাজনীতিকে চর্চা করছেন কিন্তু রাজনীতির মাঠে অংশগ্রহণ নেই। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন মাঠে, তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আজকের তরুণ নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী জ্ঞানার্জনের আবেদন থেকে বিচ্যুতি। জ্ঞানার্জন ছাড়া যেমন রাজনীতির মাঠ সম্ভব নয়, তেমনি মাঠে রাজনীতি ছাড়া নেতৃত্ব অর্জন সম্ভব নয়। যেসব ছাত্র রাজনীতিতে জড়াতে চেয়েছেন, তাঁদের তিনি বলতেন জ্ঞানার্জনে গুরুত্ব রাখতে, কারণ জ্ঞানার্জন ছাড়া ছাত্রজীবন যেই রাজনৈতিক মূল্যবোধের শূন্যতা তৈরি করে তা দিয়ে যুগান্তকারী নেতৃত্ব গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।

আজ একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যুগান্তকারী অনেক উদ্ভাবন মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার সুউচ্চ সীমানায়। তবুও পৃথিবীর বুকে রয়ে গেছে সংঘর্ষ, দলাদলি আর ক্ষমতার কোন্দল। বস্তুত পৃথিবীতে রয়েছে সবই, শুধু নেই প্রতিটি ক্ষেত্রকে ধরে ধরে গোছানোর লোক, শুধু নেই যোগ্য নেতৃত্ব। ৪৮ বছরের স্বাধীন দেশ, তবুও নেতৃত্ব শূন্যতার কাছে হার মেনে যাচ্ছি আমরা। নেতৃত্বের মানদণ্ডে যিনি আমাদের নিজে আলো হয়ে পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, যে পুরুষ প্রদীপ হয়ে অন্ধকার দূর করতে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, তাঁর দেখানো মানদণ্ডে নেতৃত্ব আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রিয় স্বদেশে চর্চা হোক তাজউদ্দীনীয় আলোর, যার প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং একই সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোরতা জাতিকে দেখিয়ে দিয়ে গেছে যুগান্তকারী নেতৃত্বের বিকাশ।

নাসরিন জেবিন: শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়