এখন এখানেই...

তারিখটা ২০১৮ জুলাইয়ের ১৫। কেউ ধারেকাছেও চিন্তা করতে পারো, কোথায় সে মুহূর্তটি!

রাশিয়া রাজধানী মস্কোর নাম শুনেছ তো নিশ্চয়ই! সেদিনটিতে সেই শহরের মধ্যেই জেগেছিল যেন আরও এক শহর। লুঝনিকি নাম তার, সেই ক্ষণে হয়ে উঠেছিল তা পৃথিবীরই রাজধানী, এ পৃথিবীর প্রাণভ্রমর! যেন তারা ঝলসিত, আলো ঝলমলানো, ঝিকমিক চিকচিক জাজ্বল্যময়ী, নয়নধাঁধানো ঘোর লাগানো, মায়াবন এনাক্ষী ঘাতক। এনাক্ষী মানে জানো তো, হরিণী চোখ। কিছু মুহূর্তের জন্য হরিণের চোখের মতোই সুন্দর হয়ে উঠেছিল সেই জেগে ওঠা শহর। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিই ছিল তার ওপর।

কারণ সেদিন সেখানে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই যে উঠতে চলেছিল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’–এর পর্দা। শেষ দিন, তবুও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাঙ্গ হবে বিশ্বের প্রাণজাগানো মেলাটির, বিশ্বকাপ ফুটবলের ২০১৮–এর চূড়ান্ত আসর। সেদিন শেষ খেলা অর্থাৎ ফাইনাল খেলার মধ্য দিয়েই পরের চার বছরের জন্য পৃথিবী নীরব হতে এগিয়ে চলেছিল।

এমন দিনে খুব মনে পড়েছে, খুব; জীবনে খাওয়া প্রথম লাথিটি। প্রথম যেদিন মার খেলাম, বয়স আর কতই বা হবে তখন! দু-তিন বছর। সাইজ ছিল ছোটখাটো, বেড়ার নড়বড়ে ফাঁক গলে, যেকোনো খেত ঢুকে যাওয়া ছিল চোখের পলকের ব্যাপার। প্রথম দিনের ঘটনাই বলে নিই।

কড়কড়ে রোদ্রমাখা আলস্যে সিক্ত অমন দিনে চোখ বুজে বেশ আয়েশ করে জাবর কাটছিল মা। ওই অতটুকুন সুযোগই ছিল আমার জন্য যথেষ্ট। চুপিসারে ঢুকে গেলাম মনিবের সবজির খেতে। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু বাবা–মাকে না জানিয়ে কিছু করলে, যা হয় তাই হলো আর কি! শসাগাছগুলোর কচিপাতায় সবে মুখটা দিয়েছি, মনিবের ছোট ছেলে দেখে ফেলল।

অমনি শুরু করল সে চিৎকার চেঁচামেচি ধুন্ধুমার, একেবারে ষাঁড়ের স্বরে। ভাবটা তার ছিল এমন, যেন অতিকায় এক রামছাগল দেখেছে! সাইজ কিছুটা রামছাগলের মতো, সে মানলাম। কিন্তু তোমরাই বলো, স্লেটকালো আর শ্বেতশুভ্র কি এক হতে পারে কখনো! মিষ্টি তুষারশুভ্র দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং আমার! মা তো আরও একটু বাড়িয়েই বলে খানিক। বাছুর বললেও হবে না, বিষয়টি হলো না বাছুর না প্রাপ্তবয়স্ক গরু—এদের মাঝামাঝি। বলা চলে কৈশোরে পা রাখতে চলা এক সুন্দর গরু আমি।

মনিব নিমেষেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। কষ্টে গড়া শসাখেতে এই আমি গরুকে দেখে মেজাজ ধরে রাখতে পারল না। পেট বরাবর কষে সজোরে একটা লাথি মারল, সেই জীবনে খাওয়া প্রথম লাথি, সে-ই প্রথম বেদনার স্মৃতি। আজ স্পষ্ট মনে আছে, অজান্তেই একটা ‘কোৎ’ আওয়াজ বের হলো, বেশ কিছুক্ষণ দূরে ছিটকে গেলাম। কতক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দে গুঙিয়েছি মনে পড়ে না ঠিক, তবে এটুকু মনে আছে, ব্যথার চোটে খেতেও পারছিলাম না কিছু। কিছুই না; না আমাদের সে কর্নফ্লেক্স-ভাতের ফেন ভেজানো খড় ভুসি; না সে প্রোটিন সে কালো খৈল। এমনকি আমাদের নিজেদের সমাজে ভিটামিন ও মিনারেলস নামে পরিচয় পাওয়া কাঁচা সবুজ ঘাস। হালকা জ্বরও এল। খুব ভয় করছিল এই ভেবে, মা আস্তটি রাখবে না, বকে মেরে দফারফা করে দেবে। অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলো, মা একটি রা তো করেইনি বরং তার অমন মায়াবী ডাগর চোখ দুটি আরও গাঢ় নিকষকালো মনে হলো। জলে ছলছল টলোমলো, হয়তো জল বেয়েও পড়েছে খুব নীরবে নিভৃতে। সেদিন মায়ের জন্যই খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু কেঁদেছিলাম অসহ্য বোবা ধরা শূন্যতায়। সে-ই আমার গোজীবনের প্রথম সজ্ঞান অশ্রু।

একটু রাত নামলে, একটা কুপি হাতে মনিব গোয়ালঘরে এল। সত্যি বলতে কি, আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম, দুম করে চোখ বন্ধ করে, ঘুমের ভান ধরলাম। তবে কি বাবার মতো আমার সঙ্গেও ঘটতে চলেছে! বাবাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। মায়ের কাছে যতটুকু শুনেছি, বাবা সম্পর্কে জানা ততটুকুই। আজকের এমন এক ভুলের কারণেই, বাবাকে চিরতরে হারাতে হয়েছিল। বাবার বয়স তখন বাড়ছিল, শেষ দিকে নাকি কিছুক্ষণ হালচাষ দিলেই তার হাঁপানির টানটা উঠত। কবিরাজ–বৈদ্য বহু চেষ্টাও করেছিল, কোনো লাভ হয়নি। হালের জোড়াটির সঙ্গেও বাবা দৌড়ে পেরে উঠত না। মা প্রায়ই একটা কথা বলত,
—গরুর জীবন নিয়ে জন্মানোই আজন্ম পাপ। সব্বাই চায় শুধু দুধ দেওয়া গাভি নয়তো হালচাষের শক্তিমান বলদ। যতক্ষণ দুধ দিতে পারবি, যতক্ষণ হাল চষে দিবি, ততক্ষণ খুব ভালো, ভীষণ ভালো, সবচেয়ে ভালো। মনিবগুলো সে সময়ে আমাদের রাজা–রানির মতো আদর-যত্নে লালনপালন করে।

সে সময় না বুঝলেও এখন হাড়ে হাড়ে বুঝে ফেলেছি, জগতের নিয়মটা এমনই। গোসমাজ শুধু নয়, পৃথিবীর তাবত প্রাণী সমাজেই যারা কাজ জানে, কাজে আসে, পরিশ্রম করতে পারে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রাখে, তারাই টিকে থাকে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে।

মনিব পরদিন সকালেই বাবাকে কাল্লু কসাইয়ের কাছে নগদ সাত হাজার টাকায় দিয়ে এসেছিল আর ফিরেছিল হাতে ব্যাগভর্তি বাজারসদাই; হাসিুমখ, সুখসুখ মন, গুনগুন গান, ভীষণ আহ্লাদময়। সে বাজারের ব্যাগে বাবাও ফিরল। টুকরো টুকরো কাটা বাবার হাড় আর মাংসপিণ্ড; অন্তিম সুন্দর শ্বাসশেষে চিরঘুমন্ত রক্তাভ বাবা সেদিন ফিরেছিল শেষবার; চিরতরে হারিয়ে যেতেই।

মনিবরা চাবুক ছোটায়, আঘাত করে, আবার আদর–যত্নও করে তারাই। চাষ দিতে দিতে কাজের ফাঁকে গান শোনায়, বাঁশি বাজায়, গোসল করিয়ে দেয়, শীতে গায়ে চট তুলে দেয়, সাজানো শোয়ার ঘর দেয়, অনেক সময় আবার নিজের সন্তান থেকেও বেশি ভালোবাসেন, কত কত মজার খাবার দেয়। শাসন করা তো তারই অধিকার, সোহাগ করে যে। সে শাসনটিও ভালো কিছুর জন্যই, গরু হয়ে অন্তত আমি তা–ই বুঝি।

মনিব সেই সন্ধ্যাতে ঘরে ঢুকতে চোখ বন্ধ করেছিলাম আর দুনিয়ার এসব হাবিজাবি চিন্তা মাথার মধ্যে এসে জড়ো হতে শুরু করেছিল। মনে মনে অপেক্ষাও ছিল, এই বুঝি শাস্তি এল, কুঞ্চির বাড়িটা বুঝিবা এখনই পিঠে পড়বে। ভয় হচ্ছিল ভীষণ, মালিক কি বাবার মতো সেই হন্তারক কাল্লু কসাইয়ের হাতে আমায় তুলে দিতে যাচ্ছে? আমাকেও আমার পিতার মতো টুকরা টুকরা হয়ে এ বাড়ির চুলোতেই জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হতে হবে! কালো মুখোশ পরা দজ্জাল ভয় আর ধুধুময়ী হন্তারক শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে চলেছে তখন।

ব্যথার তীব্রতায় ঘুমোতেও পারছিলাম না। মনিব কুপি হাতে ঘরে ঢোকার পর, ঘুমের ভান করেই নেতিয়ে পড়ে থাকলাম। মনে হচ্ছিল মালিক পা টিপে আমার দিকেই আসছে। দম ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়েছিল,
ও মালিক, আমার ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে হয়, এবারের মতো মাফ করে দাও, আর কখনই এ জীবনে সবজিখেতে ঢুকব না। তবু এ যাত্রায় আমায় কাল্লুর কাছে দিয়ো না, মালিক। দোহাই মালিক, জীবনটা ভিক্ষা দাও; জীবনটা ভিক্ষা দাও।

দুঃখ–ভয়–কষ্টে চিৎকার করার শেষ শক্তিটুকুও যেন গলা থেকে হারিয়ে গেছে, মনে হল হালকা গোঙানির আওয়াজ বেরোল কেবল। আমি অনুভব করছি, আমার পাশে কুপিটা নামিয়ে রেখে হাটু গেঁড়ে বসলেন মনিব। পেটের যে জায়গায় লাথি মেরেছিল, তার আশপাশজুড়ে খুব কোমল আদর আর মোলায়েমভাবে হাত বোলাতে লাগলেন তিনি। আমি তার অমন স্পর্শে চমকে উঠলাম; তার হাত দুটি যে রীতিমতো থরথরিয়ে কাঁপছিল। গন্ধতেই বুঝলাম, মনিবের হাতে সেই মলম, যা মায়ের ব্যথা পায়ে তিনি মাঝেমাঝে লাগিয়ে দিয়ে মাকে আরাম দেন। সে মলম প্রেমোস্পর্শে আমার ব্যথাতেও লাগালেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই জায়গাটা শীতল হয়ে এল, খুব আরাম হলো। ভয় কাটেনি পুরোটা তখনো; অনুভব করলাম নোনাজল, মালিকের চোখ বেয়ে পড়ছে আমার শরীরে; আরও একবার তীব্র চমকালাম, মালিক যে কাঁদছে। নিজের কাছে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, বেঁচে থাকতে এ জীবনে আর কোনো দিন কারও খেতে ঢুকব না।

অবাক হয়েছিলাম, ভালোও লেগেছে ভীষণ। মনিব আমাকে কাল্লুর কাছে বিক্রি করে দিতে আসেনি, দুই হাতের বেড়ে যতটুকু পারল আমায় জড়িয়ে ধরে সে তুমুল কান্নাকাটি আর চিৎকার শুরু করল,
—মস্ত বড় অন্যায় হয়ে গেছে বাপরে, তোকে ওইভাবে মারতে চাইনি বাপধন; অভাবের চিন্তায় মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছেরে, আমার আল্লায় জানে, তুই আমার সন্তানের থেকে কোনো অংশে কম না, আমারে মাফ করে দে রে বাবা, মাফ করে দে।

সেদিন জীবনে প্রথমবার কোনো মানুষকে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল, ভীষণ শক্ত করে। সেদিনেই প্রথম, এই আমি গো সন্তান, কোনো মানবসন্তানের জন্য কেঁদেছিলাম।

এরপর একে একে কেটে গেল কত বসন্ত; কখনো রঙিন, কখনো বেদনাসিক্ত বর্ণহীন। কখনো লালবাগ তো হাজারিবাগ, কখনো পেশোয়ার, কখনো বা সেন্ট পিটার্সবার্গ। অচ্ছুত কতশত স্বপ্ন, কত আশা হতাশার কান্না গান, আশাভঙ্গের বেদন, মান অভিমান, উল্লাস উন্মাদনা, সে যাতনা যে কতশত! পৃথিবী কোনো দিন তা জানতে পারবে না, জানতেও চাইবে না। জানবে না, বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল আসরের কিক-অফের জন্য অতি আদর যত্নে বানানো যে বলটি, তারও একটি সুদীর্ঘ মেঘমেদুর অতীত ছিল। সেই অতীতের ওপর দাঁড়িয়ে, সেই বলটিই সেদিন হয়েছিল বর্তমান। মাঠের সেই কেন্দ্রবিন্দুতে কীভাবে যে সময় বলটিকে টেনে এনেছিল, শুধুই সময় একমাত্র সাক্ষী তার।

সেদিন কান্না পেয়েছিল ভীষণ। কেঁদেছিও অজরে তুমুল। কিছুতেই আটকে রাখতে পারিনি চোখের জল।

তার কিছুক্ষণ পরেই, হলুদ জামা গায়ে রেফারি এল; বাশিতে ফুঁ দিতেই শুরু হলো খেলা। আমার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ দিয়ে তৈরি বলটি ঘিরে দৌড়েছিল কত নামীদামি খেলোয়াড়, মাঠের ভেতরের ৮০ হাজার মানুষ, আর বাইরের প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে শব্দদ্যোতনা অপরূপ; বিশৃঙ্খল চেঁচামেচিও কী মাধুর্যময়, বৈচিত্র্যময় বর্ণিল পোশাকি রঙিন জীবন; কিন্তু কেউ একবারও তাকায়নি, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, এত সুবিশাল সে আয়োজন সফল হতে চলেছে যার কারণে, সেই বলটির কথা। তবুও মন খারাপ করিনি কখনো, আমার কাজ আমি করে চলেছি। তাদের সঙ্গে সমানতালে দৌড়েছি পুড়েছি ভিজেছি, মেতেছি, নেচে উঠেছি, আবার কেঁদেছিও তাদের সঙ্গেই; কিন্তু কখনো থামিনি। জীবন আমায় শিখিয়েছে,
—যখন আমি ছিলাম যেখানে, থাকি যেখানে জীবন সেখানেই; কেউ মনে রাখুক অথবা নাইবা, প্রশংসা করুক অথবা নিন্দা, শুধু থেমে যাওয়া চলবে না; কখনো কোনোভাবে কোনো অবস্থাতেই না। থেমে যাওয়া তো আত্মসমর্পণ, থেমে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া, হার মেনে নেওয়া।

মন বলে খুব করে, তোমাদের সব হার মানা হার, অসহায় হাহুতাশ, দুঃখ–জরা ভরা অসভ্য ব্যর্থতা চিৎকার ছাপিয়ে বলি,

‘রেফারি বাঁশি বাজিয়েছে বহু আগে
শুরু হয়ে গেছে জীবনখেলা, সে কবেই।
বহমান, এ খেলা চির চলমান
এমনকি তুমি থেমে গেলেও।

দৌড়ুবে অন্য কোন জন, অন্য কোন ক্ষণ
বন্ধু তুমি জেনো এবং জানাও-
বাঁচো এখানে, এখুনি বাঁচো, এখানেই সময়
মনে রেখো শুধু, এখুনি সময়।"

গল্পটি শেষ নয় এখানে, বরং হলো শুরু সবে, এখনই....