বাক্সবন্দী পরম্পরা

মেহেদী হাসান তামিম।
মেহেদী হাসান তামিম।

নিবারণের শ্বাসকষ্টের টানটা হঠাৎ করেই আবার বেড়ে গেল। তার শরীরটাও বিশেষ একটা ভালো যাচ্ছে না। খানিক পরপর ঘেমে পুরো শরীর নেয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এমন ঘাম হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভগবানকে খোঁজার চেষ্টা করে। দুগ্গা দুগ্গা বলে, ওপর দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে। স্রষ্টার কাছে কাছে আরজি জানায়, ‘তুইলে নাও, ভগবান। এই অধমরে তুইলে নাও।’

কয়েক দিন ধরেই নিবারণের কেন জানি অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছে। গত বৈশাখের গরমেও এমন হয়নি। মন বলছে, কোনো জটিল ক্ষয়রোগ গোপনে বাসা বেঁধেছে। ভয়াবহ বিপর্যয়, দুর্যোগময় সময় অথবা অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু জেনেও মানুষ মনের অজান্তেই বেঁচে থাকার একটু হলেও আশাকে জিইয়ে রাখে। কিছুক্ষণ আগে যেখানে বিধাতার কাছে নিজের মৃত্যু কামবা করলেও, আকুতি করল নিবারণ, এখন মনকে খানিক সান্ত্বনা দেয়। সে ভাবে, এটা আবার রোগ না–ও হতে পারে। সূর্যের তেজ এ বছর বাড়তি, সে কারণেও হতে পারে। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা তার মতো বৃদ্ধ, অশীতিপর গামছাটি একটানে হাতে নেয়। সেই সঙ্গে কাপড় টেঁসে যাবার একটি শব্দও হলো।

বংশপরম্পরায় তাদের প্রত্যেক পুরুষ বেঁচে থাকাগুলোকে এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে ঠেলেঠুলে কোনোমতে পৌঁছাতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা শুধুই বেঁচে থাকার জন্য জীবনকে রেখে গেছে, কিন্তু কোনোভাবেই ‘জীবন’–এর জন্য বেঁচে থাকা রেখে যায়নি। শতচ্ছিন্ন হতদরিদ্র সেই সব বেঁচে থাকা পুরুষান্তরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে অবিরাম, কখনো ছিঁড়েফুঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছে, ফেটে গেছে, রং হারিয়ে বিবর্ণ হয়েছে। পেশার অংশ হিসেবেই তারা ছেঁড়া–ফাটা স্যান্ডেল চপ্পলগুলো বংশানুক্রমে সারাই করেছে, রং করা পলিশ করা পট্টি লাগানো পেরেক মেরে ক্ষত ঢেকেছে, পুরাতন অচলকে ফেলে দিয়ে নতুন সুকতলি লাগিয়ে—ফের ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে দিয়েছে। নিবারণ বিশ্বাস করে, পরিত্যক্ত জুতা চপ্পলকে যেভাবে তারা নতুন করে বাঁচার অধিকার দিয়েছে, বংশপরম্পরায় তাদের একজনও নিজ জীবন বা ভবিষ্যতের জন্য—ন্যূনতম আশাবাদও রেখে যেতে পারেনি।

দেশভাগের পরপরই জন্ম নেওয়া নিবারণ, চোখের সামনে কত কিছু বদলে যেতে দেখল, ধ্বংসও দেখল। তাদের জীবনে সেসবের কোনো কিছু ভালো-মন্দ কোনো প্রভাবই কোনোকালে পড়েনি। চর্মকারদের পেরেক ঠোকা, পেটানো, জুতার মুখ প্রবেশ করিয়ে সুকতলিতে আঠা লাগানো, রং দেওয়া, পলিশ করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা লোহার নেহাই নামক সরঞ্জামটিই যেন নিবারণের বংশগতির প্রতিচ্ছবি। ক্রমে এর ক্ষত বেড়েছে, ক্ষয়ে গেছে ব্যাপকভাবে, তবু টিকে থেকেছে, কখনো ফুরিয়ে বা মিলিয়েও যায়নি। মাঝে মাঝে খুব ভাবে, অনেক কিছুর মতোই তাদের বংশটা যদি বহু পূর্বেই পৃথিবী থেকে সমূলে বিলীন হয়ে যেত, তবে কত মানুষই বেঁচে থাকা নামক কলঙ্কের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত!

ঠাকুরদার বাপের যে একটি ঘর সম্বল, তা মাপে ছিল আট ফুট বাই আট ফুট। দাদারা ছয় ভাই মিলে আর কয়েকটা একই মাপের ঘর, আশপাশে বাড়িয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই স্বাধীনের সময় দেশ ছেড়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি। তারপর বিভিন্ন সময়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা, বিক্রি—সবকিছু মিলিয়ে নিবারণ তার বাপের ভাগে পাওয়া ঘরটা পেয়েছিল বলেই, শেষ রক্ষে। যখন ভাবে তাকে যদি একটি নতুন ঘর তুলতে হতো, রক্ত বিক্রি করেও তার পক্ষে সম্ভব হতো না। বংশপরম্পরার উন্নয়নের সকল জোয়ার সেই ছোট্ট ঘরটিতে এসেই ব্রেক কষেছে। কে জানে তার শেষটিও হয়তো সেখানেই!

ব্যবসার সবেধন নীলমণি, কাঠের তৈরি বাদামি রং বাক্সটা আলতো করে খোলে। ঢাকনার ভেতরের দিকটায় দুর্গা মায়ের কয়েকটা ছবি মহা যত্নে আঠা দিয়ে সাঁটানো হয়েছে। ডালা যতবার সে খোলে, মাকে প্রণাম করে। বাপকেও সব সময় তা-ই করতে দেখেছে। মন খারাপ হয় নিবারণের; পুরুষের পর পুরুষ মাকে কত পূজা, যত্নআত্তি করে চলেছে, অথচ প্রতিদানে কী পেল তারা! বাদামি রঙের বড় বাক্সটার ভেতর, তাকের মতো করে আরও দুটি ট্রে। প্রতিটি ট্রে আবার মাঝখানে কাঠের চিকন চেলাই দিয়ে দুই ভাগ করা। সবার ওপরে ট্রের একদিকে রাখা নাইলনের সুতা, কয়েক প্রকার সুচ, তাপ্পি। আরেকটায় ছোট বড় মাঝারি সাইজের পেরেক, ছোট্ট একটা হাতুড়ি। নিচের ট্রে-তে চামড়ার কাজের টুকিটাকি সব যন্ত্রপাতি। বাঁ দিকে নেহাই, হরেক রকম ছোট ছোট টুকরো চামড়া, কাঠের আয়তাকার ছোট তক্তা—যেটাকে ফর্মা হিসেবে ব্যবহার করে সে। সেটির পাশের খোপে চিমটে, চামড়া ও সুতা কাটার ছুরি, কালি, জুতার রং, আঠা, পলিশের ক্রিম থরে থরে রাখা।

চপ্পলের ছেঁড়া ফিতে যতবার সে সারাই করে, মনে সংশয় থাকে—গ্রাহক আদৌ ঠিকমতো মজুরি দেবে তো! মজুরির ন্যায্য টাকা চাইলেও আজকাল লোকজনগুলো বাজে রকম ঝামেলা শুরু করে দেয়! মানুষের খ্যাঁচখ্যাঁচ করার স্বভাবটা, রোদের তাপের মতোই দিনে দিনে শুধু বেড়েই গেছে। বাপ বেঁচে থাকলে বলত, ‘বাপধন, হাতের কাজ হইল একটা মস্ত শিল্প, খুবই মূল্যবান বিষয়। এর শিল্পীগো কি দাম দিয়া কেনন যায়! যায় না...’

বাপের কথাটি মনে পড়লে নিবারণের অভিমান হয়—জন্মের পর জ্ঞান হবার দিন থেকে এ শিল্পকেই সে দেখছে, লালন-পালন করছে। কিন্তু শিল্পটা তার শিল্পীদের দিকে মুখ তুলে চায়নি কখনো।

ছোটবেলার অস্থির দিনগুলোর কথা মনে হলে, আজকের নিবারণকে চিনতে পারে না। সেই তুলনায় এখন সে যেন শান্ত একটা নদী, যার স্বাভাবিক স্রোতটিও বন্ধ হয়ে আছে। যক্ষ্মা রোগে মারা যাবার আগে ছোট ভাইটার চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারছিল না বলে, বাপের ওপরে কী রাগ তার! ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালেই সে গগনবিদারী কান্নায় ভেঙে পড়ত। টানা দুই দিন না খেয়ে ছিল। যদিও ২-৪ দিন না খেয়ে থাকা তাদের জন্য খুব আলাদা উল্লেখযোগ্য ঘটনাও নয়। প্রায়ই এ রকমটি হয়। দুই দিন পর পাশের গায়ের ঝিলের পার হতে, ছেলেকে খুঁজে বের করল মা। সেদিন মা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘ও নিবু, মন খারাপ করতে নেই রে বাপ। সময়ই হইল সব থিকা বোড় ওষুধ, দেখবি তোর ভাইডিরে সব অসুখ ভগবানে ঠিকঠিক সারায়া দেবে। বাবা নিবু, ভগবানের কাছে চাইতে থাক, একদিন না একদিন শোনবই।’

মায়ের কোমল পরশে নিবারণের কান্না আরও বেড়ে গেল। মা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘বেডা মাইনষের অমনে কাঁদতে নেই রে বাপ। ও নিবু, কঠিন কইরে ভাবলে দুইনাডা খুবোই কঠিন, আর সহজ ভাবলি পরে খুব সোজা।’

মা ঠিকই বলেছিল, ভাইয়ের সব অসুখ–বিসুখই একেবারে সেরে গেল। দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে তার আবার কিসের অসুখ, কিসের বিসুখ!

সংসার খরচ চালাতে গিয়েই বাপটা দিশেহারা। সেখানে ডাক্তার, চিকিৎসা, হাসপাতাল চিন্তাগুলো তাদের জীবনের জন্য বাহুল্যই শুধু নয়, অবাস্তবও। পৃথিবীর আলোতে আসতে না পারা সন্তান মরে গিয়ে নিবারণের মনে যে দুর্যোগ সৃষ্টি করেছিল সেটি ভেবে, পিতার জীবিত সন্তান বিনে চিকিৎসায় মারা গেলে তার মনের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে, অনুভব করার চেষ্টা করে নিবারণ। আবেগ অনুভব করার চেষ্টাই বুকের ভেতরে যেভাবে তীব্র বেদনা আর যন্ত্রণায় পিষ্ট করেছে, হু হু করে উঠেছে। সেদিন না বুঝতে সক্ষম হলেও এখন প্রকৃতই অনুধাবন করতে পারে বাপের সেদিনের মানসিক বেদনাটা।

সন্তান জন্মদান আর বিনে চিকিৎসায় মৃত্যু; জন্ম আর মৃত্যু, মৃত্যু আর জন্ম—সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে এমন খেলা খেলতে খেলতেই, বংশের প্রদীপ হয়ে একমাত্র নিবারণই টিকে গেল। কে তখন জানত, আর কয়েক বছর পরে, এই বংশকে ধ্বংসকারী মূল হোতাই হবে নিবারণ।

বাপটা যদি বয়সের আগেই না মরে যেত, নির্ঘাত পাগলই হয়ে যেত। চোখের সামনে একের পর এক সন্তান মরল, মায়ের শরীরও খারাপ করেছে, এদিকে চর্মকারদের সে সময়ে চলছিল দুর্দিন। মানুষের পকেটে চাল কেনার পয়সাই জোটে না, আবার চপ্পল জুতা। যে মরে গেছে সে তো গিয়েই বেঁচে গেছে, নিবারণ আর তার ছোট ভাই যারা বেঁচে ছিল, সেই মাছুম সন্তানদের অভুক্ত মুখও একজন পিতা আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! ভগবান তাই তাকে তুলে নিয়ে যেন বাঁচিয়েই দিয়েছিল। অক্ষমতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদান করেছিল। যেন সে তার ভালো মানুষ হবার পুরস্কারটাই পেয়েছিল মৃত্যুপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে।

বর্তমানে নিবারণ হাতে গোনা যে দু–চারজনকে খুব ভালো পায়, এবাদ তাদের একজন। বয়স কম হলে কী হবে, যেমন তার আদব-লেহাজ, তেমন তার আচার-ব্যবহার। বুড়ো বয়সেও নিবারণ ছেলেটার কাছে অনেক কিছু শিখেছে, শিখছে প্রতিদিনই! কাস্টমার যখন দামাদামি করে, এবাদ এমন সুন্দর করে হাসিমুখে কথা বলে, বোঝায় তাদের দেখতেই ভালো লাগে। পাশ থেকে মুগ্ধ নয়নে দেখে সে। তার মনটা তখন খুব পোড়ায়—ভাবে, সন্তানেরা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই ওদের মতো ফুটফুটেই হতো। এবাদের গায়ের রংটা মারাত্মক কালো। অথচ মুখে সব সময় পদ্মফুল হয়ে ফুটে থাকে মুক্তা ঝরানো হাসি। তার মনে হয় সেই হাসিটি, যেন অনেক সাদা রং মানুষের সব সাদার মিলিত শক্তি হতেও অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী।

সবাই বলতে থাকে চিকিৎসা করা, নিবারণ বউটারে ডাক্তারের কাছে নে। নিবারণ কারুর কোনো কথাই শোনেনি। বরং প্রাণেমনে শুধু চেয়েছিল মৃত বাচ্চাই। পিতা যেখানে স্বয়ং সন্তানের মৃত্যু প্রার্থনা করে, কোনো ভগবান সে চাওয়া পূরণ না করে পারে৷ তাই বুঝি পরপর তিনটা বাচ্চাই মৃত জন্ম নিল। নিবারণ জানে, বউকে হাসপাতালে না নেওয়ার কারণে সকলে তাকে ভুল বুঝেছে, এমনকি বউও। তাতে কিছুই যায় আসেনি তার। অনাগত সন্তানের মৃত্যু একদিকে তাকে যেমন দুঃসহ যন্ত্রণা দিত, আবার অনাবিল আনন্দ আর শান্তিও পেত। একমাত্র সে-ই জানে নিজ মনের খবর, আর জানতে পেরেছে তার ভগবান।

দোকান খুলে বাক্স হতে মাল-সামান নামিয়ে ঝাড়পোঁছ, পিঁড়িগুলো মোছামুছি, কাজের পর হাতে গতরে লেগে যাওয়া কালি আঠা ময়লা—যা কিছুতেই লেগে যায়, ওই গামছাতেই নিবারণ কাজ চালিয়ে নিল বহুকাল। এখন বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ঘাম মোছার কাজে। সুদূরপরাহত কোন সে অতীতে গামছাটি নিয়েছিল, কোনো স্মৃতি মনে নেই তার। একসময়ের তরতাজা, পাকা রং গামছা পুরোপুরি নেতানো, স্রেফ নরম একটা ত্যানা যেন। ভেজা অবস্থায় গা মোছার সঙ্গে সঙ্গেই আঁশে রূপান্তরিত হওয়া সুতাগুলো প্রতিবার একটু একটু করে দেহত্যাগ করে গায়ে লেগে যাচ্ছে। নিবারণ ভাবে, গামছাটিও যেন তাদের বংশপরম্পরারই জুতসই প্রতীক।

বাপ যখন গেল, নিবারণের বয়স ৩৫-৪০। বদ্ধমূল বিশ্বাস তার, বাপটা খুব বেশি ভালো মানুষ ছিল বলেই, মরার সময় ভগবান তাকে কোনোরূপ যন্ত্রণা দেয়নি। শ্বাস উঠল আর মরে গেল। তার কয়েক বছর পর এক রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট উঠল মায়েরও। পরদিন ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে ভ্যান গাড়িতে করে সদর হাসপাতালেও নিল। মায়ের মুখে প্লাস্টিকের নল পুরে দুবার চাপ দিয়ে হাওয়া দিতেই, দিব্যি সুস্থ হয়ে গেল। ডাক্তার বাবু বলল, যখনি শ্বাসকষ্ট উঠুক, সে ওষুধটাই মাকে দিতে হবে। সেটার দাম শুনে নিবারণ ভিরমি খেল। অত টাকা সারা মাসে রোজগারও করতে পারেনি সে। ওষুধের দোকানে চাকরি করা তার গ্রামেরই একজন বুদ্ধিটা দিল। সদরের বড় বড় ওষুধের ফার্মেসিতে ডাক্তারবাবুর দেওয়া কাগজটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে আবেদন জানাতে থাকল সে। একজন বাবু তাকে বললও, ‘মাসখানেক পরে একবার এসো তো, কোম্পানিকে বলে দেখি কিছু করতে পারে নাকি!’

মাসখানেক অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য তখনো নিবারণের হয়নি। সাত দিন পরেই সে গেল। বাবু তার দোকানের কর্মচারীকে বলে চা আর বনরুটি কিনে দিয়েছিল। রুটির অর্ধেক খেয়ে দন্তহীন মায়ের সেটা খেতে আরাম লাগবে ভেবে বাকিটা কোমরে গুঁজে নিয়েছিল। পরপর কয়েক দিন যেতে থাকলে একসময় বাবু ডেকে বলে দিল, ‘কেউ রাজি হচ্ছে না রে, ও আর হবে না।’

মায়ের জন্য কিছু করতে না পারায় তার ভীষণ কষ্ট হতো, নিজেকে ব্যর্থ মনে হতো। বাবু না বলে দিলেও, সে ওষুধের সে দোকানের সামনে দৃষ্টিসীমায় খানিক দূরে চুপটি মেরে বসে থাকত। বাবু কোনো কোম্পানি পেয়েও যেতে পারে সে ভেবে। শেষ যেবার গিয়েছিল, দোকানের একজন কর্মচারী এসে তাকে ৫০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোকে যদি আর একবার এ তল্লাটে দেখা যায়, বাবু বলেছেন হাড্ডিগুড্ডি সব গুঁড়ো করে হাতে ধরিয়ে দিতে।’

নিবারণ কথাটি শুনে চাঁদগ্রস্ত বজ্রাহত দশাগ্রস্ত হলো। টাকাটা সে নেয়নি, আর কোনো দিন সে পথেও ভেড়েনি। যাবার প্রয়োজনও আসলে ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কয়েক দিনের মধ্যে মা-ও চলে গেল।

নিবারণ অনেক দিন ধরেই একটা গামছা নেবে নেবে করছে। সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া গামছার প্রয়োজনটা জীবনের আর প্রয়োজনের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারেনি। এত দিন ঠেকার কাজ সেরে নেওয়া গেলেও, এর যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তা আর সম্ভব হবে না। মুখ বুক পিঠ পেট, গলার তল থেকে শুরু করে বগলের তল, বেশ ভালো করে মুছে নিল। গামছাটি কাঁধে রাখতে গিয়ে মনস্থির করেই ফেলল, ভগবতী পিসিমার সেজ মেয়ে বৈশালির কাছে ভালোমতো দেখেশুনে পাঁচ হাত পাকা রং একটা গামছা নিয়েই ফেলবে। তার কাছে নেবার সুবিধাটা হলো, কিস্তিতে যেমন পাওয়া যাবে, কিস্তি দিতে না পারলেও এসে দুইটা উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েও যাবে না। আগের বছর কেনা ধুতির দাম মেয়েটি অনেকবারই সেধেছে, কিস্তিতেও দিতে চেয়েছে, কী ভেবে আর নেওয়া হয়নি তখন।

‘ও কাহা। তোমার কান্ধের গামচা নামের ওই কলঙ্কডারে এইবার জলে ভাসিয়ে দাও দিকিনি। তোমার কাছে কেইই য়ে টেকা সাইধেছে বলো! নাও। এই নাও, দিচ্চি তো। হাটবার হাটবারে ২০ টাকা কইরে শোধ দিওনি।’

নিবারণ একগাল হেসে বলেছিল, ‘ওরে মা, নেব তো। দেখ্ দেখ্, এটা এহনো কিরকমডা তাজা।’

‘তাজা না ছাই, ও গামচার বয়েস তোমার থিকে যে ঢের বিশি, সে তো বোঝাই যায়। তোমার জন্মের আগেই বুঝি বড় পিসেমশাই জামিলপুরের মোকাম হতে কিইনে এনেছিল!’

ডানপিটে মেয়েটির দুষ্টু মিষ্টি পাকনা পাকনা কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগে তার। নিবারণ ভাবে, এত বিশাল কেন তার জীবনের দৈর্ঘ্য। খোঁড়া পায়েই ছুটছে তো ছুটছে, থামার কোনো নামগন্ধই নেই। বৈশালির সঙ্গে একমুহূর্ত কথা বলতেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। অথচ তার পুরো জীবনে আস্বাদ করা এমন ছোট ছোট ভালো লাগাগুলোও সংখ্যায় এতই নগণ্য, এক বসাতে এক হাতের আঙুলের কড়াতেই সব গুণে শেষ করে ফেলতে পারবে। নিবারণ বৈশালিকে বলে, ‘বি বোকহা মিয়েছিলে তুই বাপু। নইলে কি আর—আইজ আছে কাইল নেই, যার একখান পা দাউ দাউ জ্বলা আগুনে দিইয়ে রাখাই আছে, সেই আধমরা বুড়োকে কিস্তিতে মাল সাধিস!’

‘ঠিক আচে, মাইনে নিলাম আমি বোকহা, আর তুমি খুউব চতুর। তয় কোনরহম কাহিচাল যদি করছ, ভালো হইবে না। বৈশালি যদ্দিন বিচে থাকবে কিস্তিতেই তেমারে নিতে হইবে, এই বৈশালির থিকেই নিতে হবে, পইপই করে বইলে গেলেম কিন্তু হুহুহ্হ।’

এর ফাঁকে একটা ব্লাউজ পিস বিক্রি করল এবাদ উল্লাহ। দুই দিন পর বোহিনি হইল। মনে হলো, বোহিনি হওয়ায় নিজের যতটুকু ভালো লেগেছে, নিবারণ কাকার আনন্দিত হয়েছে তার থেকে বহু বেশি। কাস্টমার চলে যেতে সঙ্গেই তাকে নিবারণ বলল, ‘বুঝলি রে বাপ, ওই বৈশালি মা, আমার মতন একডা মরা মাইনষে, কেনদিন ঠুশ কইরে মইরে যাই ঠিক ঠিকানা নাই, আমার কাছও কিস্তিতে মাল বেচতে হের একডুও ডরভয় নাই। গরীব মাইনেষের মনডা বুঝি কহনোই গরীব হয় না রে বাপ। ভগবানে একজনেরে সব জায়গায় গরীব বানাইব না মনে কইরায় মনডায় কয়, হেগো অন্তরডারে ধনী বানায়া দিছে।’

‘কাহা তুমি কথা কিনতুক ঠিগই কইছ। গরিবগো কিছু নাই বইলে, হেরা আর কিছুর খোঁজও করে না। যা চায় হেইডা পায় না। যা পায় হেইডা পাইলেই কী, আর না পাইলেই কী! হোগের জীবনেত তো কোনো পরিবর্তন হয় না। আর বড় লোকেগো কত কী যে থাহে, হেরা তাই জীবনভরা আরও আরও পাইব, বইলা খোঁজ করতেই থাহে।

নিবারণের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সময় এবাদের মনে হলো, মানুষটা যেন কত কাল না ঘুমিয়ে আছে। রাজ্যের যত ঘুম যেন তার চোখে। তার ঘামানোটা চোখ এড়িয়ে যায়নি এবাদের। কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গে সে বলে, ‘ও কাহা, তুমি এমুন ঘামাচছো ক্যান? আইজ তোমার শরীরডাও মনে হয় বিশি খারাপ করচে। দোকান-টোকান বন কইরে ঘরে যায়া রেস্ট লাও। কাহা যাও, রেস্ট লাও আইজকা।’

‘বাপধন এই একখান শরীর, তার আবার খারাপ ভালো! এক মেশিন, এক জং ধরা কলকবজা কদ্দিন আর চলব তুই-ই ক। তবুও তো মরার শরীরডা বিকল হইয়া বনও হয় নারে বাপ।’

‘কাহা, আমি তোমার কেডা লাগি যে আমার কথা শোনবা। তাও কই দোহাই লাগে আর হেলা কইরো না। কইছিলাম কী, মেলাদিন শরীরডা ভালা যাইতিছে না, সদর যাইয়ে এইবার ডাক্তার দেহাও। নিজের বাপটারে কইতে কইতে তো হেয় মইরাই গেল।’

দীর্ঘশ্বাস পড়ে এবাদের। খুব নীচু স্বরে, যেন শুনতেও না পায়, উত্তর দেয় নিবারণ, ‘যাইতম বাবা, যাইতমই ত চাই। সব থিকে বড় হাসপাতালোই যে যাইতম চাই।’

এবাদের দোকানে আবার একজন গ্রাহকই সম্ভবত এল। নিবারণ কাজে মন দেবার চেষ্টা করে। ছোট্ট দোকানটির ক্ষয়ে যাওয়া জায়গায় জায়গায় বড় বড় ফুটা হয়ে যাওয়া পাটির ওপর একটা পা মাটির সঙ্গে বিছিয়ে, অন্যটি পা হাঁটু ভেঙে খাড়া রেখে, থুতনি বরাবর রাখে। চপ্পল সেলাই করার আসন সেটা। গত দিন শেষ বেলায় ছেঁড়া ফিতা সারাইয়ের জন্য দিয়ে যাওয়া মলিন চপ্পলটি হাতে তুলে নেয়। এই কাজ দীর্ঘকাল করে করে তার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। চপ্পলের বাহিরের অবস্থা, চামড়া, চলতে চলতে সুকতলায় পড়া পায়ের ছাপ, গন্ধ রং দেখলে প্রায় নির্ভুলভাবে বলে দিতে মজুরি দেবার মালিক ক্যাঁচাল করবে কি না! হাতে এখন যে চপ্পলটি, গ্রাহক বিশাল ক্যাঁচাল করবে মনে হলো তার। তবু হাতের কাজে কখনো ফাঁক রাখে না নিবারণ। এমনকি মজুরি ঠিকমতো পাবে না জানলেও না।

তাপ্পি হাতে নিয়ে সুকতলায় ফোঁড় দেবে, প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। চৌকোনা কাঠের ফালির ওপর হাঁ করে ছেঁড়া চপ্পলটা রাখে নিবারণ। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সেটাকে শক্ত করে চেপে ধরে। বুড়ো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাপ্পির সুচ গেঁথে, নাইলনের শক্ত সুতা নিপুণ হাতে ওপরে-নিচে বার আটেক এফোঁড়-ওফোঁড় দেয়। ছোট্ট কাঁচিটি দিয়ে সুতার মাথা খুব সূক্ষ্মভাবে সাবধানে কাটে। বড় বাক্সটি হতে ম্যাচ বাক্স বের করে, সুতার মাথায় একটা কাঠি দু-তিন সেকেন্ড জ্বালিয়ে, সুতার মাথার জায়গাটিকে ঝালাই করে ফেলে। সেলাই করা জায়গাটি হাতের বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে অনুভব করার চেষ্টা করে কোনো অংশ কোনাকাঞ্চি বের হয়ে থাকল কি না। জায়গাটি অমসৃণ হয়ে থাকলে, সামান্য কারণে গ্রাহক পায়ে ব্যথা পেতে পারে, এমনকি মনেও।

চপ্পলটির সারাই শেষ। আপাতত হাতে আর কাজ নেই। সারা দিন বসে থেকে আর কাজ পাবে কি না, জানে না। ছেঁড়া ফিতা ঠিক করা চপ্পলটি নিতে এর গ্রাহক কখন আসবে, আদৌ সেদিনই আসবে কি না, সেটিও জানা নেই তার। সবকিছুর পরও দোকানেই বসে থাকতে হবে তাকে। এটিই নিয়ম। বাপ মরার আগে এই একটা নির্দেশই তাকে দিয়ে গিয়েছিল, আর কিচ্ছু না; না অন্য কোনো নির্দেশ, না অন্য কিছু।

বাপের মুখটা ছবির মতো ভেসে ওঠে। বাপের জন্য মায়া হয় তার। ভীষণ মায়া। অকারণেই কত ভুল বুঝেছে বাপকে। মানুষ যতক্ষণ কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজে পার না হয়, সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অন্য মানুষটির কোনো অনুভূতি—না দুঃখ ব্যথা কষ্ট বেদনা ঘৃণা, এমনকি আনন্দের প্রকৃত মাত্রাটুকু তার পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। বাপের কষ্ট আনন্দ দুঃখ উল্লাস স্নেহ মমতা বাপ হয়ে, মায়েরগুলো মা হয়ে, ভাই বোন বন্ধু শিক্ষক যা কিছুই- নিজে সে জায়গায় পৌঁছলেই একমাত্র অনুধাবন করা যায়। আর এর যা কিছু আন্দাজে ভাবা হয়, সেটি ভাসা ভাসা ভাবনাই। নিবারণ ভাবে, নিজে যদি কখনো পরিবারের প্রতি অক্ষমতার মধ্য দিয়ে পার না হতো, বাপের প্রতি সেই দিনের করা রাগ আজীবন হৃদয়ে নিয়েই মরে যেত সে। সে ভাবে, ভগবান যেন তার বাপের কষ্টগুলো বোঝাতেই, একই পথ দিয়ে তাকেও হাঁটিয়ে নিয়েছে।

ছোটবেলায় যখন সে বাপের সঙ্গে দোকানে যেত, কিছুক্ষণ কাস্টমার না এলে, হাতে কোনো কাজবাজ না থাকলেই অস্থির হয়ে পড়ত। খুব দ্রুতই হতাশার আগুনে পুড়ত। সেই সময় বহুদিন বাপে কেটে না দেওয়া চুল, যেগুলো কপালে চোখের ওপরে এসে পড়ত, আলতো করে তা সরিয়ে বাপ বলত, ‘নিবু রে, দোকানদারি হইলো খুবঅই ধৈর্যের একডা বিষয়। এমনেও দিন যাইব, দিন আইব—বোহিনি বাট্টা দূরত থাইক, একখান মশামাছিও উইড়ে এসে বসবে না। দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা, আরও বেশিও হইতে পারে এমন। কিন্তুক দাঁতে দাঁত খিঁইচে দম বন কইরে পইড়ে থাকন লাগে। বেদিশা হইলি তো সক্কল শেষ।
‘বাপধন শুনতাছ? মনে রাখবি বাপে, কামড়াইয়া পইড়ে থাকতে যে পারল, হে-ই ব্যবসা করতে পারল।’

দেশ স্বাধীনের পরপর একবার রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল। জীবিকার ওপর রাগ। বংশের মুচি ঐতিহ্যকে ভাঙতে চেয়েছিল সে। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, মানুষের মাথায় কি জুতা চপ্পল থাকে! সবাই নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত। দিনের পর দিন বসে থেকেও এক-আধটা কাস্টমার আসে না। তাদের আসা না–আসার সঙ্গে মিল করেই ঘরের চুলা জ্বলত। কখনো কখনো দু–চার দিন চুলা জ্বলার নামগন্ধও থাকত না।

বাবুপাড়ার ময়নাল রাজমিস্ত্রির সাগরেদ হয়ে চলে গিয়েছিল শহরে। তবে কাউকে কিচ্ছু বলেনি। জানত, বাপ যদি জানে কোনো দিনই যেতে দেবে না। মাঝখানে দু–তিন বছর দালানকোঠা রাস্তাঘাট তৈরি মেরামত থেকে শুরু করে, যখন যে কাজে ময়নাল লাগিয়েছে, অবলীলায় করেছে। স্বপ্ন একটাই—সংসারে অভাবের শেষ দেখে ছাড়বে! উল্টো ভীষণ হতাশ হলো সে। শহরের জীবনযাপনে কঠিন পরিশ্রম করেও মাস শেষে অল্প কটা টাকাও টিকত না। তার ওপরে কোনো মাসে যখন কাজকর্ম থাকত না, ধার–দেনা করেই চলতে হতো। তাই যে তীব্র রাগ নিয়ে সে বাড়ি ছেড়েছিল, তার বহুগুণ বেশি কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরতেই হলো তাকে। অনিচ্ছা নিয়ে মুচিগিরিতে নিজেকে সঁপে দিতে হলো। এমন না যে চাইলে অন্য কোনো কাজ করে খেতে পারত। জন্মের পর থেকে মানুষ যা দেখে বড় হয়, পরবর্তীকালে সেটিই তার কাছে সবচেয়ে সহজ, চ্যালেঞ্জহীন হয়।

বাপে বলত, একটা ছোটখাটো পেরেকও খোয়া গেলে, তা ব্যবসার জন্য অমঙ্গল। তাই নিত্যদিন কাজের শেষে সব আইটেম একটি একটি করে গুনে বাক্সে রাখে। সময়ের সঙ্গে বাঁকা হয়ে আসা জলখাবার অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটিও খুব যত্নে প্রতিদিন বাক্সে ভরে। নিবারণ ভাবে, সেই কাঠের বাক্সটিই তাদের পুরো এক জীবন, বংশপরম্পরায় হয়ে চলা জীবনের উন্নয়ন। জীবনের সমস্ত সুখ-অসুখ সবই যেন সে একটি বাক্সের মধ্যেই প্রতিদিন বন্দী হয়।
সন্ধ্যায় হলুদ বাক্সটিকে কাঁধে তুলে রাস্তার অন্যদিকে হামিদ মাস্টারের মুদিদোকানের বাইরে রাখা একটা পরিত্যক্ত কাঠের দেরাজে বহুদিন হলো রাখছে। আজকাল সেই একই বাক্সটি তার কাছে ভীষণ ওজন ঠেকে। রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশ পৌঁছতেই হাঁপিয়ে ওঠে নিবারণ।

বাড়িটা দোকানের থেকে আকারে সামান্যই বড়। আট ফুট বাই আট ফুটের কুঠুরি। ঘরে দেয়ালে একটি লোহার জানালা আছে। বহুদিন আলো আসেনি সেই জানালা দিয়ে। না খুলতে খুলতে জানালাটি নিজেও হয়তো ভুলে বসেছে, তার জীবনেও একদিন মুক্তি ছিল। রান্না করার ছোট্ট পাটাতন মেঝে থেকে খানিক উঁচু করে বানানো। তার ওপর অল্প কিছু বাসনকোসন, দু–চারটা ঢাকনাহীন শিশি বোতাল, আর ভীষণ রকমে মরিচা ধরা একটা কেরোসিন তেলে চলা স্টোভ। সন্ধ্যার পরে সে ঘরে নামে রাজ্যের অন্ধকার।

ঘরে একসময় বিদ্যুৎ ছিল। পল্লী বিদ্যুৎ নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে পলাশডাঙ্গা গায়ের সব ঘরেই বিদ্যুতের লাইন দিয়েছিল। প্রথম কদিন ছোট্ট ঘরগুলো ঝলমলে করেছিল ঠিকই। যখন নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ব্যাপার এসেছে, সে ঝলমলানো সূর্যমল্লিকা আলোই জীবনের জন্য বাহুল্য হয়ে উঠেছে। চোখে বা মনে কোথাও আর আরাম হয়ে উঠতে পারেনি। টাকা দিতে না পারায় যখন একে একে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো, তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

তেলের কুপিতে টিমটিমে জ্বলতে থাকা সামান্য আলোটুকু নিবারণের প্রতিদিনের সামর্থ্যে কুলিয়ে ওঠে না। কুপি জ্বাললেই কেরোসিন খরচ। সেই তেল বাঁচাতে পারলে এক বেলা বেশি ভাত রান্নার আগুনটা হয়।
রোজ রাতে ঘুমুতে গেলেই, আঁধারে যাপিত কালো হয়ে থাকা তার মনটা দার্শনিক চিন্তায় মেতে ওঠে।

রাত্রির অন্ধকারকে প্রশ্ন করে, বংশপরম্পরায় এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে, তাদের ওপর যে নিদারুণ অভাব ও দারিদ্র্য, প্রতিমুহূর্তে কশাঘাত করেছে, নিপীড়িত করেছে কেউ কি সেই বৃত্ত ভাঙতে এগিয়ে আসেনি! মুক্তির কোনো চেষ্টাই করেনি! তার রাগ হয়, কেউ বিদ্রোহ করল না কেন, জগৎটাকে উলট–পালট, তচনচ করে দিল না কেন! দোষারোপ করতে পারে এমন কাউকেই খুঁজে পায় না নিবারণ।

শেষমেশ দরিদ্রের একমাত্র এবং শেষ আসামি ভগবানের কাছেই ফেরা। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের বিছানায় শুয়ে ওপরের ছাদটিও তার কাছে মেঘাচ্ছন্ন কালো আকাশ। সেখানেই থাকে যেন সৃষ্টিকর্তা। ছাদে ভগবানের দিকে তাকিয়ে নিবারণ স্বগতোক্তি করে, ‘ভগবান, সত্য সত্যই দুইনায় কি তুমি আছো! কই আমাগো দুঃখ কষ্ট বেদনা অভাব অক্ষমতায় একবেলাতেও তো তোমারে দেখলাম না। কও তো, তুমি থাকলেই আমগো আর কি ক্ষতিই হইত পারত!’

বাড়ি থেকে পালানো ছাড়া এ বংশের জন্য সে আর কীই–বা করেছে—প্রশ্নটি তার নিত্যদিনের সঙ্গী। একবার হলেও আসে। প্রতিদিনই সে একই—লজ্জা, আড়ষ্টতা, সীমাবদ্ধতায় ভেঙে পড়ে। পূর্বপুরুষেরা তবু রিলে রেসের ব্যাটন এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে পৌঁছে দিয়েছে। আর সে জীবনের তরে তাদের পরম্পরায় দৌড়গুলোকে জোর করে থামিয়ে দিল। তার দীর্ঘশ্বাস আরও ঘোর দীর্ঘতর হয়ে ওঠে।

নিবারণ জানত, তার সন্তানেরা পৃথিবীতে এলে, ধুঁকে ধুঁকে সবাই মারা পড়ত। দারিদ্র্য, অবহেলা, বঞ্চনা, তাচ্ছিল্য, অক্ষমতা বুকে নিয়েই তাদের মরতে হতো। সে চলে আসা গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটতই শুধু। কেউ আগে আগে মরে বেঁচে যেত, আর কেউ কেউ জীবিত থেকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করত।


ঘুটঘুটে অন্ধকার ইদানীং নিবারণের বুকে হিম করা একটা ভয় তোলে। ভীষণ রকম ভয় হয় তার। অথচ স্লেটকালো এই অন্ধকার কিছুকাল আগেও গ্রহণ সীমানায় ছিল। রোগী বউটা পুরোনো আমলের একটি লোহার খাটে শুয়ে সারা রাত কাশতে থাকত। খাট বলতে ঠাকুরদার রেখে যাওয়া তোশকবিহীন লোহার তৈরি একটা কাঠামো। ঘুমের পর ঘরের বাসনকোসন তার ওপরেই শুকিয়ে নেবার জন্য ব্যবহার করা হয় বংশপরম্পরায়। ঠাকুরদার পর তার বাপ, তারপর নিবারণ সেটি পেয়েছে। এরপর পাবে আর এমন কেউই দুনিয়ায় আর নেই।

তার বেঁচে থাকা জীবনের সার্থকতা যেন সেখানেই খুঁজে পায় নিবারণ। সে মনে করে, তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সেটিই। এমন এক বংশপরম্পরাকে জিইয়ে রাখতে সে অন্তত আর একটি জীবনকে প্রহসন হয়ে বাঁচার জন্য রেখে যাচ্ছে না।

বছর সাতেক আগে বউয়ের পেটে টিউমার হলো। চিকিৎসা হয়নি। নিঃসন্তান বউটাও পৃথিবী ছেড়ে গেল। ব্যস, তখন থেকে পুরো পৃথিবীটা তার একার রাজ্য। সেদিন থেকেই নিবারণের অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়েছিল—রাজ্যের লোভকে এক ফুঁতে দৃশ্যলোকে উড়িয়ে দিয়ে রাজাহীন রাজ্য গড়া। আর কেউ কিছু না করতে পারলেও, অবশেষে সে তো কিছু অন্তত করে যেতে পারল তার বংশের জন্য। এটাই তার পরম শান্তি।

কেরোসিন ফুরিয়েছে কদিন হয়েছে। গত কয়েক দিনের মতো, আজও না খেয়েই শুয়ে পড়ল নিবারণ। রোগী বউ বেঁচে থাকতে সারা রাত খুকখুক করে কেশেই চলত। তাতে কখনো সামান্য বিরক্তিও আসেনি। বরং বউকে শ্মশানে রেখে আসার পরমুহূর্ত থেকে নিবারণের জীবনেই পরম অভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কাশির শব্দ। সারা রাতের কাশির শব্দই যেন ছিল তার ঘুম আসার সঞ্জীবনী সুধা। সেই সুর তাল লয় বউ মারা যাবার পর যেন চিরতরে কেটে গেছে। তার মনে পড়ে না বউ মরার পড়ে আর কোনো এক রাত্রিও নিবিড় প্রশান্তিতে সে ঘুমিয়েছে। তার ঘুম প্রয়োজন। ভীষণ ঘুম। গাঢ় ঘুম।

ঘুম আসছে নিবারণের...পিসেমশাই...বাবা...মা...ছোটভাই...ময়নাল মিস্ত্রি...সবাই এসেছে যেন...গত সপ্তাহে এবাদের কাছে ধার করা ২০ টাকা শোধ দেওয়া হয়নি...সে তলিয়ে যাচ্ছে...বৈশালিকে বলে বউয়ের জন্য একটা তাঁতের শাড়ি বানিয়ে নেবে...নেহাই...তাপ্পি...ভাসছে...ভীষণ খিদে...সহ্য করতে পারছে...মা জড়িয়ে ধরল...আনন্দ হচ্ছে...ভীষণ আনন্দ...

নিবারণ মিটিমিটি হাসছে...
তাচ্ছিল্যের হাসি...
পৃথিবীর প্রতি...