শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, নারী শিক্ষা

শিক্ষাকে বলা হয় পরিবর্তনের হাতিয়ার। শিক্ষা শুধু যে আত্মিক বিকাশের জন্যই অপরিহার্য তা নয়; বরং শিক্ষা বর্তমানে কর্মের দৃঢ় সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। আধুনিক সমাজ শুধু যে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে তা নয়, পাশাপাশি হয়েছে ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণও। তাই আমাদের দেশে অবৈতনিক শিক্ষা যেমন চোখে পড়ে, তেমনি সমান্তরালে চোখে পড়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। আর এর সঙ্গে ঘটেছে শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। বলতে গেলে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে একটা বিপ্লব ঘটেছে। দেশব্যাপী বিস্তার করে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই প্রভূত অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের মেয়েদের ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের মেয়েদের এই জাগরণ শুধু যে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক চেহারা পাল্টে দিয়েছে তা নয়; বদলে দিয়েছে বিশ্ব অঙ্গনে দীর্ঘদিনের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। শিক্ষা ও কর্মে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বাল্যবিবাহ, অকাল গর্ভধারণের মতো সামাজিক সমস্যাগুলোর লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছি; পাশাপাশি গড়ে উঠছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত মায়েদের একটি প্রজন্ম। এ প্রজন্ম আরেকটি বিপ্লবের জন্ম দেবে এবং অতি অবশ্যই নেপোলিয়ানের সেই বিখ্যাত উক্তি, যা স্মরণ করিয়ে দেয়—মায়েদের অন্ধকারে রেখে শিক্ষিত জাতি গঠন করা যায় না।

আমরা আমাদের মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। যদিও উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এরপরও একটা প্রবল আশাবাদী চিত্রই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুফল পেতে শুরু করেছে এবং সামাজিক স্লোগানগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে। আমরা এখন অনায়াসে বলতে পারি, ছেলে হোক, মেয়ে হোক সুসন্তান একজনই যথেষ্ট। বাংলাদেশে শিক্ষা এবং কর্মজগতে নারীর এই ব্যাপক অংশগ্রহণের আগে নারীর সমস্যাগুলো নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় এবং তার সমাধানের পথনির্দেশিকায় নারী আপন গৃহে যে নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হতো তা-ই অধিক গুরুত্ব পেত, কিন্তু নারী এখন গৃহের বাইরেও সদর্পে বিচরণ করে। তাই নারীর সমস্যাগুলো এখন আর শুধু গৃহকেন্দ্রিক নয়, বাইরের জগতের সঙ্গেও সমানভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু মেয়েদের বাইরের জগতে নিয়ে এসেছে বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে নানাভাবে এই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং তা জন-উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এখন প্রশ্নটি হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আমরা কী করে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের একটি নিরাপদ এবং সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি। বিশেষত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়, যেখানকার শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮–এর নিচে। এ বয়সের শিক্ষার্থীরা সংকোচ এবং ভয়ে অনেক সময় অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারে না, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট মানসিক পরিপক্বতা তাদের থাকে না এবং কী করা উচিত বা কী করতে হবে, তারা তা সহসাই বুঝে উঠতে পারে না। আর এর সুবিধা নিয়ে থাকে নিপীড়নকারীরা। ভুক্তভোগী এ ধরনের ঘটনা থেকে সৃষ্ট ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ায় জীবনভর। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক, বিশেষত পুরুষ শিক্ষক নিয়োগদানের ক্ষেত্রে প্রথমেই একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা উচিত, যা তাঁদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেলামেশায় এবং আচরণে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও শালীনতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি তার পাঠদানের সময়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলো যেন জেন্ডার–নিরপেক্ষ হয়, পাঠদানের ক্ষেত্রে যেন শব্দচয়নগুলো লিঙ্গবৈষম্যমূলক না হয়, সেই বিষয়গুলোও প্রশিক্ষণে থাকতে হবে। কারণ, জেন্ডার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করার মাধ্যমে শুধু যে তাদের এ ধরনের ঘটনা চেপে যেতে উৎসাহিত করবে তা-ই নয়, পাশাপাশি তারাও জেন্ডার পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়বে। যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, সেখানে অনতিবিলম্বে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সক্ষমতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক নারী শিক্ষক সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে এবং অভিযোগ গ্রহণ এবং তা তদন্ত করার জন্য প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের নেতৃত্বে টিম থাকবে, নারী শিক্ষকই অভিযোগ শুনবেন এবং সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে প্রতিবেদন দেবেন। একটি অভিযোগ বাক্স রাখা যেতে পারে, যাতে করে লজ্জা, ভয়ে বা সংকোচে যদি কেউ সরাসরি না বলতে চায়, তবে সে ওই অভিযোগ বাক্সের মাধ্যমে জানাবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পুরুষ সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ অত্যন্ত সতর্কভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং যোগদান পর্বের শুরুতেই তার জন্য ইনহাউস প্রশিক্ষণ রাখতে হবে। নিরাপদ ও সুন্দর শিক্ষাদানের পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আগমনকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে, বৈরী হিসেবে নয়। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে মা সমাবেশের আয়োজন করতে পারলে অন্ততপক্ষে প্রতি শিক্ষাবর্ষে একবার এতে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের মধ্যে যোগাযোগ অত্যন্ত সাবলীল ও সহজ হবে। এ ধরনের ভাব বিনিময় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমকে যেমন গতিশীল করতে সহায়ক হবে, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বোধকেও বাড়িয়ে দেবে। এ সবকিছুর বাইরেও যে কথাগুলো না বললেই নয়, শত ব্যস্ততার মধ্যেও অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের প্রতিদিন নিয়ম করে সময় দিতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা নিজেকে একা না মনে করে, তাদের সমস্যাগুলো শুধু যে তাদের একার সমস্যা—এ রকমটি যেন তারা কখনো মনে না করে। তার বিষয়টি যে একান্ত ব্যক্তিগত নয় এবং নীরবে চেপে যাওয়ার নয়, বরং পরিবার তার পাশে থাকবে, সেই মানসিক শক্তি তাকে দিতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষক-অভিভাবকদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতার মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ এ ধরনের নিপীড়নকে দূর করার মাধ্যমে বর্তমানকে নিরাপদ করবে আর ভবিষ্যৎকে করবে সুন্দর।

মো. আরাফাত আজাদ, প্রভাষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজ, লালমনিরহাট