রাশিয়ায় রান্নার কাজ করে ছেলেরা

মস্কোতে রিযাইন সেস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক। ছবি: নাফিজা মৌ
মস্কোতে রিযাইন সেস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক। ছবি: নাফিজা মৌ

২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোর দমোডেদোভো তে বসে অপেক্ষা করছিলাম কখন নিতে আসবে আমাকে রিযাইন সেস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে। গ্রাম থেকে কেউ যখন প্রথম ঢাকায় আসে তখন ‘যা দেখি নতুন লাগে’ এমন একটা ভাব থাকে যা আমার মনের মধ্যেও ছিল। একে তো এই দেশে এবারই প্রথম, দ্বিতীয় হলো পরিবার ছেড়ে একদম একা। মন আংশিক খারাপ আর আংশিক ভালো। ভোর তখন সাড়ে ৪টা, আমাকে নিতে এল ইউনিভার্সিটি থেকে। বিমানবন্দরের ওপারে গিয়েই প্রথমে যা চোখে পড়ল তা হলো সাদা গালিচায় মোড়ানো মানে বরফে ঢাকা প্রশস্ত রাস্তা। আর ওপরে ইয়া বিশাল আকাশ। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এই এত ভোরেও আকাশ নীল। গাড়ি করে সোজা ইউনিভার্সিটির ডরমিটরিতে। কক্ষ নম্বর ৪৩২। আমি আর একজন আলজেরিয়ার নাগরিক এই কক্ষে থাকব। পরদিন থেকে ক্লাস শুরু।

রাশিয়ার শিশুর সঙ্গে লেখক। ছবি: নাফিজা মৌ
রাশিয়ার শিশুর সঙ্গে লেখক। ছবি: নাফিজা মৌ

এখানে আমি এখন রুশ ভাষা শিখছি। পরদিন ক্লাসে গেলাম। রুমে ঢুকতেই আমাকে সম্বন্ধ করে বলা হলো দব্রেই উত্রম। আমি তখন বুঝিনি এর মানে কী? তবে, এখন খুব বুঝি। আমার ডরমিটরিতে আছে মিসর, মরক্কো, সুদান, আফ্রিকা, সিরিয়া, নেপালি, সুদানি, তাজিকিস্তানি আর রুশেরা। ২০টি কামরা নিয়ে আমাদের ডরমিটরি। এখানে রান্না আমরা একসঙ্গেই করি। নানান দেশের নানান মানুষ, আর পরিচিত হতে থাকি তাদের বাহারি খাদ্যাভ্যাস, চালচলন, রীতিনীতি আর সংস্কৃতির সঙ্গে। এখানে এখন আমার দুজন রুশ বান্ধবী। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য প্রথম প্রথম গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য লাগত। এখন আমি রুশ অনেকটা শিখে ফেলায় ওরা কী বলে আমি বুঝে যাই। আর আমি কী বলতে চাই, আমার এক-দুইটা শব্দে ওরাও বুঝে ফেলে। এই না হলে বন্ধুত্ব। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, রুশ মেয়েরা রান্নাবান্না করে না আর শেখেও না। রান্নার কাজ রুশ ছেলে অথবা পুরুষদের। মেয়েদের যারা লেখাপড়া করে তারা চাকরি করে বাসায় সন্তান পালে আর পুরুষেরা রান্না করে। সময়ে সময়ে মেয়েরা হয়তো সাহায্য করে থাকে তাদের। এই কথা শোনার পরই চোখে ভেসে এল বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্নের’ গল্পের কথা। অথচ আমাদের এখানে ঠিক তার কি উল্টো। রুশদের প্রধান খাদ্য আলু হলেও বানরুটি ওরা খুব খায়। আমিও এখন রুটিভক্ত মানে তিন বেলা রুটি খেয়ে থাকতে পারি।

রুশরা অনেক সংস্কৃতিমনা। অন্য সংস্কৃতিও তারা ধারণ করে পালন করে। আর সঙ্গে করে সম্মান। ছবি: নাফিজা মৌ
রুশরা অনেক সংস্কৃতিমনা। অন্য সংস্কৃতিও তারা ধারণ করে পালন করে। আর সঙ্গে করে সম্মান। ছবি: নাফিজা মৌ

রুশরা অনেক সংস্কৃতিমনা। অন্য সংস্কৃতিও তারা ধারণ করে পালন করে। আর সঙ্গে করে সম্মান। ক্লাস শেষে বিকেলে যখন হাঁটতে যাই, দেখতে পাই প্রকৃতির একটু একটু পরিবর্তন। পাতা ঝরা শূন্য জীর্ণ ডালগুলো আজ সবুজ সজল জ্বলজ্বলে। বরফ কাটতে শুরু করার পর দেখি রুশের এক অন্য রূপ। সাগা লেকে যেই হংসগুলো কনকন শীতে গুড়ুমুড়ু হয়ে থাকত, সেগুলো এখন পাখনা মেলে লেকের স্রোতে ভেসে বেড়ায়। দেখতে যা কী দারুণ, তা লেখে প্রকাশ করা যাবে না। রুশ দম্পতি এই লেকে ছুটির দিনে তাদের শিশুদের নিয়ে বেড়াতে আসে এখানে।

কনকনে শীতে রাশিয়া। ছবি: নাফিজা মৌ
কনকনে শীতে রাশিয়া। ছবি: নাফিজা মৌ

শিশুরা দোলনায় খেলা করে আর করে ছোটাছুটি। কেউ বাজায় আবার ভায়োলিন, কেউ সুর তোলে গানের। কেউ কেউ গল্প করে সঙ্গীর সাথে, কেউ আবার ছবি আঁকায় থাকে মত্ত। দিন শুরু হয় এখন রাত পৌনে ৩টা থেকে। দিন এখন এখানে ২১ ঘণ্টা আর সূর্যমামা দবদব করে জ্বলে। সূর্য থাকলেও ঠান্ডা বাতাস। আর তখনো এখানে আকাশ নীল।

নাফিজা মৌ: রিযাইন সেস্ট ইউনিভার্সিটি, রাশিয়া