এক অপরাজিতা 'শৈলী'র গল্প

নারী
নারী

বাবার ছবির ওপর গড়িয়ে পড়া চোখের জলের শব্দে হঠাৎই চমকে উঠে শৈলী। স্মৃতির ঘোরে কখন যে চোখ জলে ভরে উঠেছে। বাবা-মারা যাওয়ার আজ প্রায় ১০ বছর হতে চলল। অথচ এখনো শৈলী বিশ্বাস করে বাবা বুঝি তাকে ফোন করবে। মোবাইলের স্ক্রিন যেভাবে আবারও ‘মাই বাবা’ কলার লগ-এ ভেসে উঠবে। বাবা বলবে, ‘এখনো লাঞ্চ করেনি? লাঞ্চ করে নাও তাড়াতাড়ি।’
|
অফিসের কাজের চাপে শৈলী প্রায় লাঞ্চ করে না ঠিকমতো। কাজের সুবাদে সারা দিন প্রায় ওপর নিচ করতে হয়। লিফটম্যান মনসুর ভাই প্রায় শৈলীকে বেশ বকার সুরে বলে “ম্যাডাম, এত কাজ করে কি হবে? খাওয়া-দাওয়াটা ঠিকমতো করেন”; শৈলী মুচকি হাসে মনুসর ভাইয়ের কথা শুনে। 


বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের একটি বিভাগের দায়িত্বে আছে শৈলী। জীবনে যা কিছু শিখেছে তার ৯০ ভাগই শৈলীর বাবার শিক্ষা। নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে কাজ করাটা শৈলীর জন্ম সূত্রে পাওয়া।
শৈলীর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মদক্ষতা আর সততায় শৈলীর বাবা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভীষণ সাধারণ জীবন যাপন করতেন তিনি। কিন্তু তার দুই মেয়ে শৈলী আর সায়ন্তীকে বড় করেছিলেন রাজকুমারীদের মতো আদর যত্নে। শৈলীর ছোট বোন সায়ন্তী বর্তমানে একটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

বাবাকে হারানোর পর থেকে অনেকটাই বদলে গেছে শৈলী। সর্বদা ঠোঁটের কোণে হাসি, চঞ্চল স্বভাব আর অল্প সময়ের মধ্যে কারও সঙ্গে ভাব জমাতে পারা শৈলী কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাবার বয়সের কোনো মানুষের সঙ্গে কথা হলে তাঁর মাঝে নিজের বাবাকে খুঁজতে থাকে মনের অজান্তেই। নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু একটা জিনিস খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে আর সেটা হলো হাজারো কষ্ট মনের কোণে লুকিয়ে রেখে মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে সবার সঙ্গে সুন্দর করে কথা বলতে পারাটা। লিফটম্যান মনসুর ভাইয়ের কথাটা প্রায় শৈলীর মনে পড়ে। জীবনে সব কাজের সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ার বেদনাটা যেমন তেমনি লিফটম্যান মনসুর ভাইয়ের মতো মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার পরিমাণটাও কম না শৈলীর জীবনে।

স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আর দুই মেয়ে-আলো আর অলীকে নিয়ে শৈলীর সংসার। বাবার মতো করে যত্ন করতে কেউ পারে না। সবাই হয়তো তাদের নিজেদের প্রয়োজনে শৈলীকে কেয়ার করে বা ভালোবাসে বা সম্মান করে। কিন্তু বাবা; বাবা তো শৈলীর জন্য শৈলীর কেয়ার করত। প্রচণ্ডভাবে বাবা ভক্ত বা বাবা ঘেঁষা বা বাবার অন্ধভক্ত যত বিশেষণই ব্যবহার করা হোক না কেন সবকিছুই যেন কম পড়ে যায় শৈলী আর তার বাবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। শৈলী আর তার বাবার কথাগুলো ছিল মৌন। অর্থাৎ শৈলী মনে মনে কিছু বললে বাবা জেনে যেতেন। শৈলী খুব অবাক হতো কীভাবে শৈলীর মনের সব কথা বাবা বুঝে যায়। কিন্তু বাবাকে কখনো জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। শৈলী নিজেও বোঝে যে তার বাবা তাকে যেভাবে ভালোবাসত, শৈলী তার দুই মেয়েকে কখনই সেভাবে ভালোবাসতে পারবে না। হয়তো এই জন্যই শৈলীর চোখে তার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।

কর্মক্ষেত্রে কাজের সুবাদে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। কিন্তু এই শ্রেণির বিভাজনের সংজ্ঞাটা শৈলীর অভিধানে একেবারেই ভিন্ন। এখানে এক শ্রেণির মানুষের আধিক্য বেশি, যারা তাদের পূর্ব কর্মদক্ষতার নেম প্লেট, পদমর্যাদা আর ক্ষমতার দম্ভ নিয়ে নিজেদের চারপাশে একটি বলয় তৈরি করে রাখেন। অন্যের কাজের ভুল বের করা তাদের একমাত্র কাজ। শৈলী এই শ্রেণি মানুষদের নামকরণ করেছে ‘ব্রহ্ম গোষ্ঠী’।

একজন নারী হিসেবে শৈলীর কর্মদক্ষতা অনেকাংশই প্রশংসনীয়। অল্প সময়ের মধ্যে শৈলী নিজের কর্মদক্ষতা দিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেছে নিজের জন্য। কিন্তু, এই সমাজ, এই জাতি এখনো একজন নারীকে তার কর্মক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার কথা খুব সহজে ভাবতে পারে না। বর্তমানে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কখনো লাঞ্ছিত হচ্ছে শারীরিকভাবে, আবার কখনো মানসিকভাবে। কখনো বা ঘরে আবার কখনো বা বাইরে। আমাদের এই চিরচেনা সমাজ প্রতিদিন নানা কৌশলে শৈলীর মতো নারীদের উন্নতির পথে তৈরি করে বাধা। যখন অন্য কিছুতে শৈলীর মতো নারীদের পথ চলা রোধ করতে পারে না তখন চারিত্রিক সনদে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। শৈলীর মতো হাজারো নারী, যারা তাদের মেধা আর কর্মদক্ষতা দিয়ে ওপরে উঠতে পেরেছে তাদের অনেককেই এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে হয়েছে। খুব অবাক করার হলেও সত্যি যে সেই ‘ব্রহ্ম গোষ্ঠী’র মানুষগুলো শৈলীর মতো কোনো এক মেয়ের পিতা অথবা ভাই অথবা স্বামী।

শৈলী একাকী বসে কাঁদে, তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য সে তার বাবাকে ফিরে আসতে বলে। শৈলীর বিশ্বাস, আজ সে পিতৃহীন বলেই হয়তো অন্যেরা তাঁকে এইভাবে কথা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করার সাহস পাচ্ছে। বাবাকে হারাবার কষ্টটা আবার যেন প্রবল হয়ে ওঠে। সব কষ্টগুলো আবার শৈলীর দুচোখ বেয়ে নেমে আসে। শৈলীর ভীষণ রাগ হয়। মনে হয় রিজাইন লেটারটা সেই ‘ব্রহ্ম গোষ্ঠী’র সামনে ছুড়ে দিয়ে আসে। কিন্তু পরের ক্ষণেই বাবার কথাগুলো শৈলীর মনে পড়ে, ‘জীবন মানেই যুদ্ধ আর আঘাত পেয়ে যুদ্ধ থেকে সরে আসাটা সৈনিকের ধর্ম নয়। জিততে পারাটা বড় কথা নয়, বড় কথা যুদ্ধে টিকে থাকতে পারাটা। তোমার জীবনে বাধা আসা মানেই তুমি বুঝে নিবে যে তুমি সফল হচ্ছ। আর যারা তোমার কাজে বাধা সৃষ্টি করবে তারাই তোমার সফলতার মূল কারণ হবে একদিন। তৈরি করো নিজেকে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিদিন আরও বড় বাধা প্রতিরোধ করবার জন্য।’

বাবার কথাগুলো মনে পড়তেই শৈলী একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়। নিজে নিজেই বলতে থাকেন, ‘আমি পারব, পারতে আমাকে হবেই। আমি পারব বাবা, তোমার জন্য আমি নিজেকে আবার প্রমাণ করব। আমি তোমার শৈলী।’

আজও শৈলী কাজ করে যাচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানে। কাজ করছে নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর কর্মদক্ষতার সঙ্গে। কিন্তু, আমাদের সমাজে এমন অনেক শৈলীই আছে যাদের মাঝে সেই যুদ্ধ করার শক্তি জোগানোর মতো কোনো কথা নেই। তাদের লাঞ্ছিত করে হয়তো এই সমাজের ‘ব্রহ্ম গোষ্ঠীরা’ অহংকারের দামামা পেটাচ্ছে। কিন্তু, সময় এসেছে সেই ব্রহ্ম গোষ্ঠীর মুখোশটা উন্মোচনের। নারীদের শুধু শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করাই অপরাধ নয়, মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করাটাও অপরাধ আর এই অপরাধের ও আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

*দীপ্তি সরকার: উপপরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান, জনসংযোগ বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি