নগরের জনসংখ্যা শুধু বাড়ে না, কমেও!

ঢাকায় হাতি খেদায় পোষ মানানো হাতি, উনিশ শতক
ঢাকায় হাতি খেদায় পোষ মানানো হাতি, উনিশ শতক

ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ শহরের জনসংখ্যাই কিন্তু একটা সময় ক্রমাগত কমেছে! প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে অর্থাৎ সতেরো শতকে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় নয় লাখ। ১৭০৪ সাল থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে ঢাকার জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ১৭৬৫ সালে এই নগরের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে চার লাখের মতো। ১৮০১ সালে সেটা হয় দুই লাখ। এরপর অব্যাহতভাবে নিম্নগামী এ জনসংখ্যা ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৬৯ হাজার জনে।

রাজধানী স্থানান্তর এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর খ্যাত (১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) চরম দুর্ভিক্ষ ও কয়েক দফা দীর্ঘস্থায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঢাকার অনেক এলাকাকে জনবিরল করে তুলেছিল। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ক্রমশ ঘন জঙ্গলে আবৃত এক বনভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ‘খেদা’ ব্যবসার প্রসার ঘটে তখন। কোম্পানি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হয়ে ওঠে একটি বড় পুঁজির লাভজনক ব্যবসা। সরকারিভাবে গন্ডার, হাতি এবং বাঘ ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিক্রি করা হতো। এ ব্যবসা তত্ত্বাবধানের জন্য সরকারি কর্মকর্তাও নিযুক্ত হতো!

উপযুক্ত প্রতিবেশ পেয়ে ঢাকা হয়ে পড়ে মশা বৃদ্ধির এক উর্বরতম স্থান। ম্যালেরিয়া রোগে এখানকার অধিবাসীরা তখন নিয়মিত আক্রান্ত হতেন। বর্তমান পুরানা পল্টনে ছিল সেকালের ঢাকা সেনানিবাস। এখানকার অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এতই কুখ্যাতি অর্জন করেছিল যে, সেখানে বদলি হওয়াকে সে যুগে কঠিন শাস্তি বলে মনে করা হতো। সমকালীন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহিত্যেও তা স্থান পেয়েছিল। স্যার জর্জ ট্রেভেলিয়নের লেখা ‘লেটারস ফ্রম অ্যা কমপিটিশন ওয়ালাহ’-তে দেখা যায়, আবেগপ্রবণ নায়ক মার্সডেন তার প্রিয়া ফ্যানি’র উদ্দেশ্যে অধীরভাবে বলছে—‘তুমি একজন সত্যিকারের দেবী। আমি তোমার জন্য মরতেও পারি। আমি তোমার জন্য আমার বিশেষ ছুটি, যা এত দিন ধরে পাওনা রয়েছে, তাও দিয়ে দিতে পারি; এমনকি আমি তোমার জন্য বিনা বেতনে ঢাকাতে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেজিমেন্টের সঙ্গেও চাকরি করতে পারি।’

১৮৮৯ সালে সাত ওয়ার্ডবিশিষ্ট ঢাকার মানচিত্রে পুরোনো ক্যান্টনমেন্ট (সেনানিবাস)
১৮৮৯ সালে সাত ওয়ার্ডবিশিষ্ট ঢাকার মানচিত্রে পুরোনো ক্যান্টনমেন্ট (সেনানিবাস)

শুধু ম্যালেরিয়াই নয়, সেকালে গুটি বসন্ত এবং কলেরাও ছিল মহামারীরূপে। মারাত্মক ছোঁয়াচে কলেরা পরিচিত ছিল ‘ওলাওঠা’ নামে। পুরো উনিশ শতক জুড়েই ছিল এই মহামারির ভয়াবহতা। মহামারির এই বর্ণনা দিতে গিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘ঢাকায় ওলাওঠা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৮৮১ সন। ঢাকায় তখন যে রূপ ওলাওঠার প্রকোপ হইয়াছিল, সেইরূপ উৎকট অবস্থা বড় দেখা যায় না।’ সেন্সাস অব ইন্ডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উনিশ শতকের শেষ ভাগে এসে জনসংখ্যা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৯১ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ হাজার। পরবর্তীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকে। ঢাকা বাসযোগ্য হয়ে ওঠাটাই ছিল জনসংখ্যার এই শ্রীবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ইতিহাস পর্যালোচনায় তার প্রমাণ মিলে। এক ঝাঁক উদ্যমী সরকারি কর্মকর্তার নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে ঢাকা হয়ে ওঠে সত্যিকারের এক সুন্দর শহরতলি। জেমস টেইলর তাঁর ‘অ্যা স্কেচ অব দ্যা টোপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা’ গ্রন্থে এই দৃশ্যপটকে প্রাচ্যের ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

সেই ভেনিস কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। উনিশ শতকের শুরু থেকেই তার প্রয়াস শুরু। ১৮২৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডজ রমনার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার এবং প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট সংস্কার ও অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে শহরবাসীকে ঐতিহাসিক ‘রেসকোর্স’ উপহার দেন। পরবর্তীতে শহরের আরেক দফা উন্নয়ন ঘটে ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টারসের সময়ে। পুলিশ বিভাগকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ম্যাজিস্ট্রেট জেমস গ্র্যান্ট। ১৮৪০ এর দশকে শহরের সংস্কার ও আধুনিকায়নে ব্যাপক অবদান রাখেন রাসেল মোরল্যান্ড স্কিনার নামে আরেকজন ম্যাজিস্ট্রেট। ঢাকা শহর থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুষ্টিয়ায় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে টার্মিনাল পর্যন্ত নিয়মিত স্টিমার সার্ভিস প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকার ডিভিশনাল কমিশনার সি.টি বাকল্যান্ড। বুড়িগঙ্গা নদী তীরে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ বাঁধ নির্মিত হয়েছে তাঁর অনুপ্রেরণায়। যা ‘বাকল্যান্ড বাঁধ’ নামে খ্যাত। শুধু সৌন্দর্য বর্ধন বা অবকাঠামো নির্মাণই নয়, এ সকল কর্মকর্তার প্রচেষ্টায় ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল ও ঢাকা কলেজের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল।

প্যানোরমা অব ঢাকা (১৮৪০)
প্যানোরমা অব ঢাকা (১৮৪০)

সেই ঢাকা আজ মেগাসিটি। ওলাওঠার পরিবর্তিত সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু নিয়ে তৈরি হচ্ছে নিত্য-নতুন মিথ। ডেঙ্গুর পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া মাত্রই মৃত্যুভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। হাসপাতালের উপচে পড়া ভিড় সামাল দিচ্ছেন একালের ওয়াল্টারস-বাকল্যান্ডরূপী চিকিৎসক ও নার্স। ডেঙ্গুর উপসর্গ, কারণ, প্রতিষেধক ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা এবং জনসচেতনতায় কাজ করে যাচ্ছেন ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বলসহ নাম না জানা আরও শত চিকিৎসক। সেবা দিতে গিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে মারা গেছেন চিকিৎসকও। তবে আশার কথা হলো, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হলেও উপযুক্ত চিকিৎসা পেয়ে প্রায় ২২ হাজার ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় ও রক্ষা পায় না’—এই আপ্ত বাক্য মাথায় নিয়ে, ডেঙ্গু প্রতিকার ও প্রতিরোধে আমাদের সকলের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। ইতিহাস সাক্ষী ইতিপূর্বে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আবারও ঘুরে দাঁড়াব নিশ্চয়।

সহায়ক গ্রন্থ
১। ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস, সম্পাদক: দেলওয়ার হাসান
২। ঢাকা ইতিহাস ও নগর জীবন ১৮৪০-১৯২১, শরীফ উদ্দিন আহমেদ
৩। স্মৃতির ঢাকা, সম্পাদনা: কাজল ঘোষ

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: লেখক ও গবেষক