হৃদয়টা কী বিশাল ছিল তাঁর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: মাসুক হেলাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: মাসুক হেলাল

আগে থেকে কিছু বলা–কওয়া নেই, কোনো নোটিশ নেই। হুট করে পুলিশ নিয়ে হাজির সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের লোকজন। তিনতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত সব কটি বাসার মালামাল হুড়মুড় করে নিচে টেনে নিয়ে মাটিতে ফেলে রাখল। বাসার গৃহিণীদের চোখ কপালে—এ কেমন দস্যিপনা সদ্য স্বাধীন দেশে!

আসবাব তেমন নেই। খাট-চৌকি, চেয়ার-টেবিল আর সংসারের অতি দরকারি জিনসপত্র ন্যাংটা শিশুদের মতো এদিক–সেদিক হাঁ করে আছে। বাচ্চাকাচ্চাসহ মায়েরা মানে গৃহিণীরা উদ্‌ভ্রান্তের মতো পাশে দাঁড়ানো। ঘরের পুরুষেরা তখন অফিসে। উচ্ছেদকারীদের কড়া হুকুম, ‘যেখানে যাওয়ার যাবেন, এই বাসাগুলোতে আর উঠতে পারবেন না। আপনারা সবাই অবৈধ দখলদার।’

সময়টা ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের। পাকিস্তান থেকে নিজেদের স্বাধীন দেশে ফিরে আসা চাকরিজীবী বাঙালিদের মধ্য থেকে ৪৮টি পরিবার নিরুপায় হয়ে আগারগাঁওয়ের নির্মাণাধীন চারটি তিনতলা সরকারি আবাসিক ভবনের ৪৮টি ফ্ল্যাটে ওঠেন। দরজা-জানালা কিছুই ছিল না। আপাতত মুলি বাঁশের বেড়া লাগিয়ে দরজা-জানালার কাজ চালানো হচ্ছিল। গোসলের ব্যবস্থা ছেলেদের জন্য নিচে একটি কুয়োতে, মেয়েদের জন্য বাঁশের চাটাইঘেরা টিউবওয়েলে। শৌচাগার সব নিচে।

পরিবারের কর্তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাঁদের কাছে অপশন রেখেছিল যে তাঁরা সে দেশে থেকে যেতে পারেন অথবা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। অল্প কয়েকজন ছাড়া তাঁরা সবাই দেশে ফিরে যাওয়ার অপশন দিয়ে চলে এসেছেন। রাজধানী ঢাকায় এসে তাঁদের অধিকাংশই যাঁর যাঁর ডিপার্টমেন্টে পুনরায় নিয়োগ পেয়েছেন।

সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত অফিস টাইম। অপ্রত্যাশিত উচ্ছেদের উদ্বেগজনক সংবাদ পেয়ে অফিস সময় পার হওয়ার আগেই ওই সব পরিবারের কর্তারা চলে আসেন। হতবিহ্বল হৃদয়ে সবাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। বয়সে ও পদমর্যাদায় যাঁরা জ্যেষ্ঠ, তাঁদের ওপর পরবর্তী করণীয়ের দায়িত্ব পড়ে। কীভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে পরস্পর মিথস্ক্রিয়া চলে।

সিদ্ধান্ত হয়, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। এ অসহায় অবস্থার কথা, দুঃখের কথা তাঁকে জানাবেন। তাঁদের কথা, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো আর শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন! তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, গণমানুষের নেতা, যিনি আমাদের একটি নতুন দেশ দিয়েছেন, নতুন জাতি দিয়েছেন, সারা জীবন শোষিত-নির্যাতিত জনগণের পাশে থেকেছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে দেখা দেবেন, আমাদের কথা শুনবেন।’ অবশ্য কেউ কেউ আবার নিরুৎসাহিত করলেন এই বলে যে সবাই এখানে ‘আন-অথরাইজড’ এটা জেনে হয়তো ব্যক্তিগত সহকারী সাহেবই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না।

কিন্তু মুরব্বিরা সিদ্ধান্তে অটল। এখনই যাবেন গণভবনে, কাছেই তো! তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাশেম। তিনি আমাকে বললেন, ‘বাবা, তোমার হাতের লেখা সুন্দর। পরবর্তী ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে বসবাসের অনুমতি প্রার্থনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর তুমি সাদা কাগজে একটা দরখাস্ত লিখে দাও।’

আমরাও তখন ওই উচ্ছেদের শিকার।

একটা শিহরণ খেলে যায় শরীরজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার লেখা যাবে! তিনি আমার লেখা নিজ চোখে দেখবেন! ভেবে ভেবে আমি উত্তেজিত। বিলম্ব না করে যতটা সম্ভব স্পষ্ট ও সুন্দর হস্তাক্ষরে একটা দরখাস্ত লিখে ফেললাম। ওটা নিয়ে ১৫ থেকে ১৬ জন ব্যাকুল চিত্তে ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনা দিলেন গণভবনের দিকে।

খোলা আকাশের নিচে ৪৮টি পরিবার অপেক্ষমাণ। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরের খাবার কারও খাওয়া হয়নি বিস্কুট-চানাচুর ছাড়া। কেউ তাকাচ্ছেন এদিক, কেউ তাকাচ্ছেন ওদিক। ফলাফল কী হলো, খবর নেওয়ারও কোনো উপায় নেই।

হঠাৎ দেখা যায় ওই মুরব্বিরা ফিরে আসছেন। সবার মুখে যেন বিজয়ের হাসি। আর আমাদের মনে কৌতূহল। তাঁদের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী আবুল হাশেম বললেন, ‘বলেছিলাম না তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলেই হবে! আরে এত বড় কলিজা বঙ্গবন্ধুর! কোনো তুলনা নেই তাঁর! আল্লাহ যেন তাঁর এই নেক বান্দাকে, আমাদের মহান নেতাকে অনেক অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখেন! আমি তো বলব, এ রকম বিশাল হৃদয়ের জনদরদি প্রধানমন্ত্রী এই মুহূর্তে বিশ্বে দ্বিতীয়জন নেই।’

সবাই জানতে চাচ্ছিল আসলে কী হলো। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘শোনেন, আমি যখনই তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করতে যাচ্ছিলাম, তখনই তিনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “তোমরা কেন এসেছ?” আমি দরখাস্তটা তাঁর হাতে দিলাম আর পুরো বৃত্তান্ত খুলে বললাম। তিনি ওই কাগজে চোখ বুলিয়ে নিলেন, আমাদের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর রেড ফোনটা তুলে নম্বর ঘোরালেন। তারপর ওপাশের সালামটা নিয়ে বললেন, “সোহরাব শোনো, (আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব হোসেন তখন সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী) তোমার লোকেরা আগারগাঁওয়ের নতুন কোয়ার্টারগুলো থেকে আমার কর্মচারীদের বের করে দিয়েছে। নারী, বাচ্চা-বুড়ো সবাই মালামাল নিয়ে মাটিতে বসে আছে। মনে রাখতে হবে, ওরা পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে, সেখানে সবকিছু ফেলে আমার টানে বাংলাদেশে চলে এসেছে। ওদের দিকে নজর দেওয়া তোমার–আমার কর্তব্য। তুমি বিষয়টা এখনই দেখো। আর ওদের জন্য অলটারনেটিভ বাসার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত ওরা এখানেই থাকবে।”’

সব কথা তখনো শেষ হয়নি। এতটুকু শুনেই উপস্থিত সবাই উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তারপর মালামাল নিয়ে আগের মতো যে যাঁর বাসায় উঠে গেলেন। এদিকে আমি মনে মনে খুব খুশি এই ভেবে যে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আমার লেখার ওপর পড়েছে! তাঁর হাত আমার লেখা স্পর্শ করেছে! আমি নগণ্য আজ ধন্য।

যে কথা সেই কাজ। কয়েক মাসের মধ্যেই সবাই মিরপুরে নতুন সরকারি বাসার বরাদ্দপত্র পেয়ে যান এবং মালামালসহ নিজ নিজ নতুন বাসায় উঠে পড়েন। ইতিমধ্যে আবুল হাশেমসহ তাঁদের অধিকাংশই মারা গেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা আজও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আর তাঁর জন্য স্রষ্টার কাছে দোয়া করেন।

সাইদুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব