শত প্রতিকূলতায় ঘুরে দাঁড়ানো হাসিবের গল্প

খন্দকার হাসিবুজ্জামান নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত
খন্দকার হাসিবুজ্জামান নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা খন্দকার হাসিবুজ্জামান হাসিবের নিরন্তর জীবনসংগ্রামের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প এটি। পথ চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলা। আবার নতুন পথের সন্ধান। এভাবেই হাসিব তাঁর পথচলার চিত্রায়ণ করেছেন।

খন্দকার হাসিবুজ্জামান হাসিব। জন্ম ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুশলীবাশা গ্রামে। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, একেবারেই প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন অনেক আগেই। মা গৃহিণী। চার ভাই, দুই বোনের সংসারে খন্দকার হাসিবুজ্জামান জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তৃতীয়। প্রাথমিক শিক্ষার পাট গ্রামের বাড়ি থেকে চার কিলোমিটারের এক মাদ্রাসায়। অন্যান্য ছাত্রের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বছরের বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসার জন্য ধান, পাট ও রবিশস্য সংগ্রহ করতেন। সময়-সময় ওয়াজ মাহফিলের জন্য টাকা তুলতেও বাধ্য করত মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এত কিছুর পরও শ্রেণিকক্ষে পড়া না পারার শাস্তি ছিল নির্মম।

সে সুবাদে মাদ্রাসাশিক্ষার ইতি ঘটে পঞ্চম শ্রেণিতেই। নানিবাড়ির কাছে এক স্কুলে ভর্তি করে দেন মামা। সেখানে অবশ্য বেশি দিন মন টেকেনি। নতুন করে ভর্তি হন নিজ গ্রামের স্কুলে। বাবার সীমিত আয়ের কারণে টিউশনির মাধ্যমে পড়ার খরচ জোগাতে হয়েছে কিশোর বয়স থেকেই। বছরজুড়ে ধান বোনা, কাটা, মাড়ানো ও শুকানোর মতো গৃহস্থালির নিত্যনৈমিত্তিক কাজও করতে হয়েছে তখন। বাবা নিয়মিত বেতন পেতেন না বিধায় একপর্যায়ে ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্বও নিতে হয়েছে। স্কুলের পাট চুকিয়ে কলেজে ভর্তি হন। নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য না থাকায় বড় ভাইয়ের পুরোনো শার্ট আর চাচার পরিত্যক্ত কোট সম্বল করে রাবারের স্যান্ডেল চেপেই হাজির হন কলেজে। বেল্টের অভাবে প্যান্ট বাঁধা হয় দড়ি দিয়েই। দীনহীন এই পোশাক দেখে হাসির রোল পড়েছিল সহপাঠীদের মধ্যে। তখনো তাঁরা জানতেন না খন্দকার হাসিবুজ্জামানের অন্তর্নিহিত সেই গুণের কথা—প্রতিশ্রুতিশীল এক আবৃত্তিকারের কণ্ঠাভিনয়ের কথা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন আগত অতিথির উদ্দেশ্যে মানপত্রের পাঠে অভিভূত হয়ে শিক্ষক-সহপাঠীনির্বিশেষে তাঁকে কাছে টেনে নেন। শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ হলো ফি ছাড়াই। নিজ কলেজ ছাড়াও ওই অঞ্চলের অন্যান্য স্কুল-কলেজ আয়োজিত আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ ও নিয়মিত পুরস্কার পাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হলো খন্দকার হাসিবুজ্জামানের!

আউটডোর শুটিংয়ে নিরাপত্তা মাস্ক পরে টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত
আউটডোর শুটিংয়ে নিরাপত্তা মাস্ক পরে টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত

‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!’—মঞ্চে আওড়ানো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা তাঁর চলার পথে শক্তি জুগিয়েছে বারংবার। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে স্নাতকে পড়ার জন্য খুলনায় এক আত্মীয়ের শরণাপন্ন হলেন। ভর্তি হলেন খুলনা বি এল কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। দৌলতপুরের এক বাড়িতে তিনবেলা খাওয়া আর দুবেলা পড়ানোর শর্তে পান টিউশনি। নিজ থাকা ও পড়ার খরচের জন্য ফিলিং স্টেশনে রাতে গাড়ি ধোয়ার কাজ জুটালেন। গাড়িপ্রতি পেতেন ৫০ টাকা। কিন্তু এতে নিজের খরচ মিটলেও ছোট দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ জুটানোর জন্য বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টেম্পো চালালেন। একদিকে দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনি, আবার অন্যদিকে কলেজে পড়ার চাপ। হঠাৎ মাথায় এল, ঢাকা যেতে পারলে হয়তো আয়-রোজগার আরও বাড়ানো যাবে। ভাবনামতোই কাজ। বি এল কলেজ ছেড়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন।

ইনডোর এডিটিংয়ে ব্যস্ত টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত
ইনডোর এডিটিংয়ে ব্যস্ত টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় এসে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি গবেষণা সংস্থায় কাজ জুটল। প্রতিদিন দেড় শ টাকা করে। কাজটা ছিল জরিপের। ঢাকা কলেজের পড়াশোনাটা তখন হয়ে গেল পার্টটাইম আর চাকরিটা হয়ে গেল ফুলটাইম। পাশাপাশি চলল টিউশনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে এবং পরিচিত আরও কয়েজনের মেসে মেসে সাময়িক থাকার ব্যবস্থা হলো। ‘অ্যাড ফ্লাস মিডিয়া কমিউনিকেশন’–এর কর্ণধারের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে ওই কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি হলো। এখান থেকে অডিও-ভিজ্যুয়াল এডিটিং এবং প্রিন্টিংয়ের বিষয়গুলো খন্দকার হাসিবুজ্জামান ভালো করে রপ্ত করলেন। একপর্যায়ে এখানকার চাকরি ছেড়ে উচ্চ বেতনে ‘ইজেল’ নামক আরেকটা মিডিয়া ফার্মে যোগ দিলেন। দুটি মিডিয়া ফার্মে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এবং সঞ্চয়ের অর্থে একটা ব্যবসার পরিকল্পনা করলেন খন্দকার হাসিবুজ্জামান। তিন বন্ধুর সঙ্গে অংশীদারত্বে নয়াপল্টনে ছোট আঙ্গিকে একটা মিডিয়া ফার্ম করলেন। এখানকার লভ্যাংশ থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো পুঁজি হলো। বায়িং হাউসের একটা কাজ করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে পুনরায় চাকরিতে ফিরলেন। যোগ দিলেন একটা টেলিমিডিয়া ফার্মে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস দেওয়ার সুযোগ হলো এখানে। পাশাপাশি ডকুমেন্টারি কাজ শেখার সুযোগ হলো পূর্ণ মাত্রায়। অডিও-ভিজ্যুয়াল জগতের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও পরিচয় ঘটল।

আউটডোর শুটিং নির্দেশনায় টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত
আউটডোর শুটিং নির্দেশনায় টিম ইমপ্রেসিভ। ছবি: সংগৃহীত

ইতিমধ্যে বাজারে নতুন আরেকটি নিউজ চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করায় উচ্চ বেতনে সেখানে যোগ দেন খন্দকার হাসিবুজ্জামান। সময়টা অনুকূল ভেবে সংসার পাতলেন। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করেই নিউজ চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেল। কাজ করার সুযোগ পেলেন গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়ের কমিউনিকেশন বিভাগে। এখানে কিছুদিন কাজ করে যোগ দিলেন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে। নিত্যনতুন ডকুমেন্টারি তৈরির অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হলেন সেখানে। ২০১৪ সালে ফটোগ্রাফি, ডকুমেন্টারি ও মিডিয়া কমিউনিকেশনের কাজকে ঘিরে নিজেই একটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান দিলেন। নাম দিলেন ‘ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনস’। বন্ধু রেজার সুবাদে পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হলো। পিকেএসএফের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাজও পেতে থাকলেন নিয়মিতভাবে। নিজস্ব এডিটিং প্যানেল, হাই রেকল্যুশন ডিএসএলআর ক্যামেরাসহ একঝাঁক কর্মচারীর জন্য পুরো একটা ফ্লোর ভাড়া দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে এই উদ্যোক্তার। খন্দকার হাসিবুজ্জামানের এই পথচলা দেখে বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠিত বা পরীক্ষিত পথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করলেই উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। একজন উদ্যোক্তা তাঁর রাস্তা নিজেই তৈরি করেন। এখানে ঝুঁকির সম্ভাবনা শতভাগ থাকলেও তাঁরাই সফল হন, যাঁরা সাহস করে হেঁটে আসেন।

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ