সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার উপায়

সড়ক দুর্ঘটনা
সড়ক দুর্ঘটনা

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে ঈদের আগে এবং পরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত হয়েছে এবং মারাত্মক আহত হয়েছে ৯০৮ জন মানুষ। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে।

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো না কোনো তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিবছর হাজারো মানুষ পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব দুর্ঘটনার ফলে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবারের এগিয়ে যাওয়া। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে এবং যারা আহত হয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছে, একমাত্র তারাই এর কঠিন যন্ত্রণা এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। এই কঠিন বাস্তবতা আপনার আমার জীবনে যেকোনো সময় ঘটতে পারে। অতীতে আমরা বহু ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এত দুর্ঘটনা? এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ কি নেই? কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অথবা ফিটনেস না থাকার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। আমার পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি, শুধু চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং রোড সাইন না বুঝে যেখানে সেখানে ওভারটেক করার কারণে ঘটছে এসব মারাত্মক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার আরও অনেক কারণ রয়েছে। এসব কারণ সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই অবগত আছি। তবে দুর্ঘটনার জন্য মূল ভূমিকা পালন করেন চালক নিজে।

ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে সেটাও আমি চালককে দায়ী করব। কারণ গাড়ি বের করার আগে গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে সবকিছু পরীক্ষা করার দায়িত্ব চালকের। বর্তমান বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন বাসচালকেরা। একজন চালককে বুঝতে হবে, তাঁর ওপর নির্ভর করছে গাড়ির সব যাত্রী ও তাঁদের পরিবারের জীবন। তাঁর একটা ভুলের কারণে যেকোনো পরিবারে আসতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতি। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গাড়ির মালিক অনেকাংশে দায়ী, কারণ অনেক মালিক গাড়ি মেরামত না করে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালাতে চালককে বাধ্য করেন। একজন চালক একটানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর কথা, অথচ মালিকেরা তাঁদের দিয়ে প্রায় ১৩-১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষ করে সকালের দিকে যেসব দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, সেটা ঘুমের কারণে ঘটে। গাড়ি চালানো অত্যধিক পরিশ্রমের কাজ। যেকোনো সময় ঘুম চলে আসতে পারে। তাই মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন যদি বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত, তাহলে এই সব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। অনেক যাত্রী চালকদের দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করেন। এটা পরিহার করতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। তাই মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ গাড়িগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও পুলিশের তৎপরতার কারণে অনেক এলাকার মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়িগুলো বন্ধ আছে।

মহাসড়কের সমস্যাগুলো অল্প সময়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের গাড়ির গতি কমাতে হবে। বাস এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটারের ওপরে হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কের বাঁকে। বাঁক এলাকায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাদা লম্বা দাগ দেওয়া থাকে। এসব জায়গায় ওভারটেক করা নিষেধ। আমাদের দেশের বেশির ভাগ চালক রোড সাইন না বুঝে ওভারটেক করার চেষ্টা করেন, ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার আগে চালকদের রোড সাইন, গাড়ির হেডলাইটের সঠিক ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইনের বেসিক বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। বর্তমান অধিক সিসিযুক্ত বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে অনেক প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে মা-বাবা সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।

মহাসড়কের এসব দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারা দেশে স্পিড গানের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতি জেলায় টিম নিয়োগ করতে হবে এবং প্রতিটি টিমকে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারণ করে দিয়ে স্থান পরিবর্তন করে স্পিড গানের মাধ্যমে গতি শনাক্ত করে দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করতে হবে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে মহাসড়কে চালকেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে সাহস পাবেন না। গাড়ির গতি শনাক্ত করার জন্য একজন পুলিশ সদস্য স্পিডগান এবং ওয়াকিটকিসহ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছে থাকবেন। দ্রুতগতির গাড়িগুলো শনাক্ত করে নির্ধারিত ৫০০ মিটার দূরে অবস্থানরত টিমকে জানাবেন কত গতিতে গাড়ি চলছে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে অবহিত করে যদি ওই সব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং এ ক্ষেত্রে জরিমানা মালিকের পরিবর্তে চালককে বহন করতে হয়, তাহলে পরবর্তী চালক দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকবেন। এ পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার মাধ্যমে কাজ করার জন্য পুলিশ সুপার কর্তৃক বাছাই করা পুলিশের সৎ ও পজিটিভ মনের অধিকারী সদস্যদের নিয়োগ করতে হবে। এর সঙ্গে যদি প্রতিটি টিমে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা যায় এবং দুই ঘণ্টা অন্তর জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার নির্দেশনামূলক পরামর্শ দেন, তাহলে ওই টিম কাজ করতে উৎসাহিত হবে। এ ছাড়া এ টিম মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ইজিবাইকসহ মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়ির বিরুদ্ধে জরিমানা করে মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

স্পিড গানের ব্যবহার যদি সারা দেশে মহাসড়কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থান পরিবর্তন করে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে নগদ জরিমানা করা অব্যাহত থাকে, তাহলে আমার বিশ্বাস সারা দেশের মহাসড়ক সাত দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ আসতে বাধ্য। আর জাতি এই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে। আমার অভিমত, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে যে নগদ জরিমানা আদায় করা হবে, তার শতকরা ৫০ ভাগ টাকা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উক্ত টিমকে ইনসেনটিভ হিসেবে দেওয়া হলে ওই কাজ করতে তাঁরা উৎসাহিত হবেন।

লেখক: পুলিশ পরিদর্শক, শহর ও যানবাহন, ঝিনাইদহ