কাজী নজরুলের শৈশবই শক্তিশালী অণুপ্রেরণা

কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত।

পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম।

নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) পবিত্র কোরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র ১০ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাঁকে। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওই মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সঙ্গে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান, যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামি চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।

মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্যবয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন। চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল। এ ছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এই দলের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাঁদের সঙ্গে অভিনয় শিখতেন এবং নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম ও অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সঙ্গে হিন্দুধর্মের গ্রন্থ, অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তাঁর নাট্যদলের জন্য বেশ কিছু লোকসংগীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘চাষার সঙ’, ‘শকুনীবধ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘আকবর বাদশাহ’, ‘কবি কালিদাস’, ‘বিদ্যাভূতুম’, ‘রাজপুত্রের গান’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘মেঘনাদবধ’। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তবজীবন, অন্যদিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল প্রচুর শ্যামাসংগীত রচনা করেন, নজরুল তাঁর শেষ ভাষণে উল্লেখ্য করেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু–মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

১৯১০ সালে নজরুল ইসলাম লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তাঁর প্রতিভায় সবাই যে মুগ্ধ হয়েছিল, তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাঁকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান ‘আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন/ ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে/ নামেতে নজরুল ইসলাম, কী দিব গুণের প্রমাণ’, এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে, যা পরবর্তী সময়ে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যিনি সেকালের কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,

‘ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।’

যা হোক, আর্থিক সমস্যা তাঁকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এরপর একজন খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের একটি দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মধ্যেই তাঁর বাল্যজীবন কাটে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহর সঙ্গে কবির পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন, তা দেখে রফিজউল্লাহ তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে মাধ্যমিকের প্রি–টেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।

*মেহেদী হাসান তামিম