সাফল্যের সূত্র

পড়ালেখার পাশাপাশি সারা বছর নানা আয়োজন চলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। ছবিটি কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ফেস্টিভেলের সময় তোলা। ছবি: সংগৃহীত
পড়ালেখার পাশাপাশি সারা বছর নানা আয়োজন চলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। ছবিটি কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ফেস্টিভেলের সময় তোলা। ছবি: সংগৃহীত

সারা দেশে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার যখন ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, তখন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৮৯। পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অকৃতকার্য হয়েছে মাত্র একজন। এই তথ্য জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল সার্বিকভাবে হতাশাজনক হলেও আমাদের ফলাফল ভালো হয়েছে। এই সাফল্যের মূলে রয়েছে কলেজের পরিচালনা পর্ষদ। একাডেমিক কার্যক্রম, শৃঙ্খলা, নিয়মিত মনিটরিং—এসব ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন। আমাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডারের কোনো হেরফের হয় না।’ অর্থাৎ ছাত্র নং অধ্যয়নং তপর ব্যত্যয় ঘটার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা যে সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা-ও নয়। বিতর্ক, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সারা বছর সরব থাকে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ প্রাঙ্গণ। সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোই তাঁদের পড়ালেখার পরিবেশ আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

তাহজিব তাসনিফের কথাই ধরুন। কলেজে সায়েন্স ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, আবার উচ্চমাধ্যমিকে ঠিকই পেয়েছেন জিপিএ-৫। ক্যাম্পাসের নিয়মকানুন মেনে চলতে চলতে তাঁর জীবনেও একটা শৃঙ্খলা এসে গেছে। রেসিডেনসিয়ালের মাঠে সারা বছর কোনো না কোনো আয়োজন লেগেই আছে। খেলা যাদের পছন্দ, তারা ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকে। পড়াশোনাই যাদের একমাত্র আগ্রহ, তারাও বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে। তাহজিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সায়েন্স ক্লাব ছাড়াও কালচারাল ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, আর্ট ও ফটোগ্রাফি ক্লাব এবং মিউজিক ক্লাব আছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ওদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত।

এই কলেজেরই আরেক ছাত্র শেখ শাহরিয়ার হোসেন। কলেজের হয়ে অংশ নিয়েছে ন্যাশনাল সায়েন্স অলিম্পিয়াডে। বিজ্ঞান পছন্দ, ভালো লাগত ফুটবল খেলতে। তার জানামতে, এতগুলো মাঠ আর কোনো স্কুল বা কলেজে নেই। সত্যিই তো, ছোট-বড় সব মিলিয়ে রেসিডেনসিয়ালে খেলার মাঠই আছে এক ডজন। এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন জয়ন্ত সাধু। ক্যাম্পাস তাকে টানত প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে। বলছিলেন, ‘আমরা অধিকাংশ বন্ধুবান্ধব সেই ক্লাস থ্রি থেকে একসঙ্গে আছি। তাই এই বন্ধুত্বটা অন্য রকম। কলেজে যেতে ইচ্ছে না করলেও শুধু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য হলেও যেতাম।’

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে দুই ধরনের শিক্ষার্থী আছে। একদল আবাসিক, আরেক দল অনাবাসিক। ক্যাম্পাসের ভেতরে ‘হাউস’-এ থাকে আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তাদের জীবন কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ উল্লাহ বলে, ‘আমাদের নিয়মকানুন একেবারে ক্যাডেট কলেজের মতো। সকাল শুরু হয় সেই ছয়টায়। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, ক্লাস। বিকেলটা খুব চমৎকার। কারণ, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য মাঠে খেলতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। রাতে শিক্ষকেরা পড়াতে আসেন। কারও কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে সেই বিষয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে পড়া দেখে নেওয়ার সুযোগ আছে।’ এ কারণেই এই কলেজে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটাও অন্য রকম।

কলেজ ছাড়ার আগে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন স্বাদীদ আফ্রিদি। তাঁর কাছে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে মজার সময় টিফিন পিরিয়ড। ‘আমরা ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের মধ্যে দল ভাগাভাগি করে ফেলতাম। এরপর টিফিনের বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিতাম মাঠে ছুট। বৃষ্টি আর কাদায় ফুটবল খেলার সুযোগ আর কখনো পাব কি না জানি না,’ বলেন স্বাদীদ। স্বাদীদের মতো কয়েকটি ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন সামির। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্লাবের আনন্দ আয়োজনগুলো বেশ উপভোগ্য বলে জানান তিনি। বলছিলেন, ‘আমাদের সাত আটটা ক্লাব আছে, সব ক্লাবই অ্যাকটিভ। প্রত্যেকটি ক্লাবের একটা করে উৎসব হয়।’

সদ্য পাস করা এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, পড়াশোনার বাইরে এসব আয়োজন, প্রতিযোগিতা, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে বেশ রঙিন সময় পার করেন তাঁরা। কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যও তা-ই। কেবল পড়াশোনায় ভালো শিক্ষার্থী নয়, বরং নেতৃত্বগুণসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম তৈরি করাই তাঁদের লক্ষ্য।