পেঁয়াজের ঝাঁজ

উৎপাদনকারী অসহায় কৃষক পেঁয়াজের ঝাঁজে ফেলেন চোখের পানি। ছবি: সংগৃহীত
উৎপাদনকারী অসহায় কৃষক পেঁয়াজের ঝাঁজে ফেলেন চোখের পানি। ছবি: সংগৃহীত

পেঁয়াজ বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান মসলাদার ফসল। উৎপাদনের দিক দিয়ে মসলাজাতীয় ফসলের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জনকারী একটি ফসল। পেঁয়াজকে রান্নাঘরে যেমন বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়, তেমনি রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বৈদেশিক নীতিতেও একে নিয়ে নানাভাবে খেলা হয়। এ কারণে পেঁয়াজের ঝাঁজ দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। অন্যদিকে উৎপাদনকারী অসহায় কৃষক পেঁয়াজের ঝাঁজে ফেলেন চোখের পানি।

কেন উৎপাদনকারী অসহায় কৃষক পেঁয়াজের ঝাঁজে প্রতিবছর চোখের পানি ফেলেন, তা একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ একর (সূত্র: Report on The Productivity Survey of Onion Crop-2014, BBS)। এ জমিতে প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২২-২৫ লাখ মেট্রিক টন (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন, ১৬ আগস্ট, ২০১৮)। তাহলে আমাদের ঘাটতি প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন (এর কম-বেশি হতে পারে)। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ পরিবার আছে । প্রতি পরিবারে প্রতিদিন ২০০ গ্রাম করে পেঁয়াজের ব্যবহার হলে বছরে পরিবারপ্রতি দরকার ৭৩ কেজি। সেই হিসাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ পরিবারের জন্য পেঁয়াজ প্রয়োজন হবে প্রায় ২৪ লাখ ৮২ হাজার অর্থাৎ প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার ঘাটতি প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, এটা প্রতিবছর রয়েই যাচ্ছে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি দেশীয় পেঁয়াজের দাম ৭০-৮০ টাকা। আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৬০-৭০ টাকা। গত ৩ দিনে দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, আর ১ মাসে ৪০ শতাংশ (সূত্র: টিসিবি)।

অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর পেঁয়াজের ফলন বাম্পার হয়েছে। তবে বাজারে দাম কম থাকায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক। এ বছর ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম ছিল ১২-১৫ টাকা কেজি । অথচ গড়ে ১ কেজি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে খরচ পড়ে যায় প্রায় ১২ টাকার মতো। অতিরিক্ত কম দামের কারণে, বেশি ফলন তাঁদের জন্য কোনো সুখের বার্তা বয়ে আনেনি। এটা অসহায় কৃষকের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৃষকের এ কষ্টের সময় তাঁদের পাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ওই সময় সরকারকে এ বছর পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, বুঝিয়ে লাখো টন পেঁয়াজ ভারত থেকে এলসি করে আনার জন্য দেনদরবার শুরু করে দেন। একদিকে ফরিয়ারা ভরা মৌসুমে পানির দামে পেঁয়াজ কিনে আড়তদারদের দেন। আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে এলসি করে পেঁয়াজ কেনেন। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল, একদিকে যেমন কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত পেঁয়াজ কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অন্য সময় উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজার থেকে তাদের বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। আবার অন্যদিকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ফরিয়াদের কাছ থেকে কম দামে পেঁয়াজ কেনেন, বেশি করে মজুত করেন এবং তাঁরা সেই পেঁয়াজই সাধারণ ক্রেতার কাছে ৩ গুণ দামে বিক্রি করছেন। দুই ঈদে পেঁয়াজের দামে যে আগুন হয়, সে কথা না-ই বা বললাম। অথচ বহু কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমরা প্রতি বছর ৭-৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করছি হয় ভারত থেকে, নয়তো মিয়ানমার অথবা চীন থেকে।

খুচরা বাজারে সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৭০ টাকায় উঠেছে। তাই টিসিবি কিছুটা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে টিসিবির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনছেন এক ক্রেতা। ১৭ সেপ্টেম্বর তোলা।  প্রথম আলো
খুচরা বাজারে সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৭০ টাকায় উঠেছে। তাই টিসিবি কিছুটা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে টিসিবির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনছেন এক ক্রেতা। ১৭ সেপ্টেম্বর তোলা। প্রথম আলো

আমরা সহজ একটি ফর্মুলা কেন বুঝি না। দেশের মোট চাহিদা কত টন, উৎপাদন হয় কত টন আর ঘাটতি থাকে কত টন, সেটা বের করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। যে পরিমাণ ঘাটতি থাকে, সেটা পূরণের জন্য সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা দরকার। সেই প্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিলেই আমরা আমদানিনির্ভর দেশ না হয়ে রপ্তানি করে এমন দেশের তালিকায় নাম উঠবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এ ক্ষেত্রে চাই সরকারের সদিচ্ছা। ৭-৮ লাখ টন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার কৃষকদের একটু সহযোগিতা করলেই হয়। ফসল তোলার সময় সরকার প্রতি পেঁয়াজের দাম ২৫-৩০ টাকা ঘোষণা করতে পারে। যদি এমন কঠোর পদক্ষেপ নেয় যে এর নিচে কেউ কিনতে পারবেন না। কোনো ফড়িয়া কিনলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া সরকার চাইলে নিজেই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কিনতে পারে। তাহলেই ৮০ শতাংশ সমাধান ওইখানে হয়ে যায়। আমরা জানি, ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ, উৎপাদন ব্যয় এবং ফসলের সঠিক বাজারমূল্য সরাসরি আন্তঃসম্পর্কিত। এসব বিষয়ের প্রতি সরকারকে যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে, যাতে কৃষক ফসল তোলার সময় ফসলের ন্যায্য দাম পান। এ জন্য সরকারকে ফসল তোলার ১ মাস আগে ক্রয়মূল্য ঘোষণা করতে হবে, যাতে কৃষক দাম থেকে বঞ্চিত না হন। তাহলে চাষিরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে পেঁয়াজ আবাদ করবেন এবং পেঁয়াজের ৭-৮ লাখ টন ঘাটতি পূরণ করা কোনো কঠিন ব্যাপার হবে না। ফলে প্রতিবছর পেঁয়াজ নিয়ে তোলপাড় হবে না এবং বহু কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ভারত থেকে আর পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। বাজারের দুর্বল দাম নিয়ে কৃষকের মনে যদি হতাশা না থাকে, সরকারের সংগ্রহ মূল্য যদি উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়, মৌসুমের পূর্বে যদি সঠিক মূল্য ঘোষণা করা হয়, তাহলে কৃষকেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন পেঁয়াজের আবাদ তাঁরা করবেন কি করবেন না।

সরকার যদি নিচের পদক্ষেপগুলো অতিদ্রুত গ্রহণ করে, তাহলে প্রতিবছর পেঁয়াজের ঝাঁজ থেকে রক্ষা পাবে এবং আর কোনো দেশ থেকে নতুন করে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। পদক্ষেপগুলো হলো—ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ কোনোভাবেই আমদানি না করা, উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের জাত আবাদের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে কৃষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মৌসুমের আগে ক্রয়মূল্য ঘোষণা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো, কৃষকেরা যেন স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা; স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত বাজারে কৃষকদের পেঁয়াজ বিক্রি করতে উৎসাহিত করা; শস্যগুদাম ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে কম সুদে পেঁয়াজচাষিদের ঋণের ব্যবস্থা করা; কোনো এলাকার কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন এ বিষয়ে সেখানের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা; পেঁয়াজকে ১ নম্বর মসলাজাতীয় ফসল হিসেবে ঘোষণা করা; মশলা গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা; পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য অল্প করে হলেও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা; পেঁয়াজের বড় বড় আড়তদারের গুদামগুলোকে রেগুলার মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা। উল্লিখিত প্রদ ক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও যশোরের এলাকার কৃষকের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি বেকার সমস্যার সমাধানও অনেকটাই হবে। আর এতে বর্তমান সরকার যে কৃষকবান্ধব সরকার তার প্রমাণের একটি সুযোগ থাকবে।

আবারও আমি সরকারের কাছে জোরালো আবেদন করব—ফসল তোলার সময় কোনোভাবেই যেন পেঁয়াজ আমদানি করা না হয়। অসহায় কৃষকের বেঁচে থাকার অবলম্বন পেঁয়াজের সঠিক মূল্য যেন তাঁরা পান, অতি কম দাম কৃষক ও তাঁর পরিবারের স্বপ্নকে যেন ছিন্নভিন্ন করে না দিতে পারে, এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সব বিভাগকে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাহলেই দেখবেন ৭-৮ লাখ টন পেঁয়াজ আর আমদানি করতে হবে না। দুই ঈদ ও অন্যান্য সময়ও পেঁয়াজের ঝাঁজ থাকবে না। গুণগত মানসম্পন্ন পেঁয়াজের ঝাঁজে চোখের জল পড়ুক কিন্তু কম দাম ও অযৌক্তিকভাবে আমদানি করা পেঁয়াজের ঝাঁজে কৃষকের যেন চোখের জল ও হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ না হয়। কৃষিবিদ ও সাধারণ নাগরিক হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের প্রতি এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কৃষিবিদ মো. আব্বাস আলী