শতবর্ষ পেরিয়ে কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগার

কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগার। ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগার। ছবি: সংগৃহীত

অসতো মা সদ্গময়/ তমসো মা জ্যোতির্গময়

আমাকে অসত্য হতে সত্যে নিয়ে যাও, আমাকে অন্ধকার হতে জ্যোতিতে নিয়ে যাও।

মানবজীবনের ইহাই শাশ্বত প্রার্থনা। তাতে জীবন উজ্জ্বল আলোকিত ও অমৃত হয়।

এ প্রার্থনা ছিল পাঠকদের উদ্দেশে, রামমালা গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের। আজ ঐতিহ্যের পীঠে কুমিল্লা রামমালা গ্রন্থাগারের নামের পাশে তাঁর নামও উচ্চারিত হচ্ছে সমানতালে সবার কাছে।

১৯১২ সালে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের কুমিল্লা বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়।

গ্রন্থাগারের কথা বললেই, প্রিয় সাহিত্যিক রাজকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেন, ‘অনেকে মনে করেন, আমেরিকার গ্রন্থাগারের উন্নতির মূলে রয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু তা সত্যি নয়। গ্রন্থাগারের উন্নতির জন্যে যে সামান্য অর্থ ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় করতে হয়, সে অর্থ ব্যয় করতে জনসাধারণ মোটেই বিমুখ হয় না। এর কারণ, জনসাধারণ সেখানে গ্রন্থাগারের মূল্য বোঝে গ্রন্থাগার যে তাদের কতটা প্রয়োজন মেটাতে পারে, সেখানকার জনসাধারণ জানে।’

বাংলার একজন কৃতিসন্তান মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। মানবজীবনে মহৎ উদ্দেশ্যসাধনে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম। কঠোর শ্রম ন্যায়পরায়ণতা, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস এবং মহৎ আদর্শের ওপর নির্ভর করে তিনি নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে জীবন সাধনায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একদা কঠোর দারিদ্র্যের জন্য লেখাপড়া করার সুযোগ না পেয়ে পরে অর্থ উপার্জন করেন।

১৯১২ সালে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের কুমিল্লা বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। ছবি: সংগৃহীত
১৯১২ সালে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের কুমিল্লা বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

এ মহাপুরুষ কুমিল্লা (সাবেক ত্রিপুরা), অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানাধীন বিটঘর গ্রামে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে ১৭ অগ্রহায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ঈশ্বরদাস তর্ক সিদ্ধান্ত সপণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা রামমালা দেবীদেব্য দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ সাধ্বী নারী ছিলেন। ‘রামমালা গ্রন্থাগার’ তাঁর অমর কীর্তির মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠাতার মায়ের নামে ১৯১২ সালে জ্ঞানীদের তথা এ অঞ্চলের জ্ঞানপিপাসুদের গবেষণার সুবিধার্থে রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মফস্বলের গবেষকদের দরিদ্র ছাত্রদের কল্যাণের জন্য এই প্রতিষ্ঠান বিরাট ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক চুক্তিমতে রামমালা পুঁথি বিভাগের প্রায় ২ হাজার ৫০০ পুঁথি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোফিল্ম করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের বহু গবেষক রামমালা পুঁথি বিভাগে বিভিন্ন পুঁথির ওপর গবেষণার জন্য আসেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, যাতে সাধারণ পাঠককের জন্য জীবনচরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পুঁথি বিভাগে প্রাচীন সংস্কৃতি ও বাংলা পুঁথি আছে। পাঠকদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ফি বা অর্থ গ্রহণ করা হয় না। যেকোনো পাঠক ও গবেষক এই গ্রন্থাগারে অধ্যয়ন করতে পারেন। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।

বর্তমানে পুঁথি বিভাগের অমূল্য পুঁথিগুলো (প্রায় আড়াই হাজার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইক্রোফিল্মি করে রাখছে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে রামমালা গ্রন্থাগারের অবদান অসীম। গবেষক ও অনুসন্ধানীদের জন্য রামমালা গ্রন্থাগার প্রিয় থেকে প্রিয়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকে এই গ্রন্থাগার থেকে পড়ে গেছেন।

রামমালা গ্রন্থাগারে বহু দুর্লভ বই আছে। ছবি: সংগৃহীত
রামমালা গ্রন্থাগারে বহু দুর্লভ বই আছে। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে শাকতলা নামক স্থানে (বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের বিপরীতে) মূল রামমালা গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৩ সালে সুদৃশ্য এই ভবনে রামমালা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এই অঞ্চলে এক বিরাট ঘটনা। শান্ত নিবিড় পল্লির কোলে আলোয় জ্বলে ওঠে রামমালা। মায়ের নামে ১৯১২ সালে রামমালা গ্রন্থাগার, সেখানে আবার বাবার নামে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দেবালয়। ১৯১৯ সালে নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস (৬২ জন ছাত্রী আছে বর্তমানে), প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নাটমন্দির। পরের বছর ১৯২৬ সালে রামমালা ছাত্রাবাসের ছাত্ররা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেয়। সেই ঐতিহ্যবাহী রামমালা গ্রন্থাগারে উপমহাদেশের সুদূর ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকেও গবেষকেরা আসেন। খুঁজে পান তাঁদের দুর্লভ তথ্যটি।

গবেষণা বিভাগে ইসলাম ধর্মদর্শন, বৌদ্ধধর্মদর্শন, খ্রিষ্টানধর্মদর্শন এবং অপরাপর ধর্ম ও দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থ আছে। তা ছাড়া ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য ও দর্শনের গ্রন্থ আছে। সাধারণ বিভাগে ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ পাঠকের উপযোগী জীবনগ্রন্থ, ইতিহাস, ভ্রমণবৃত্তান্ত, উপন্যাস প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্র–পত্রিকা আছে। পুঁথি বিভাগে সনাতন ধর্ম ও দর্শনের প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থ ও সংস্কৃতি বিষয়ক হস্তলিখিত গ্রন্থ আছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অর্থের বিনিময়ে এই পুঁথি সংগ্রহ করা হয়েছে।

মানবজীবনে জ্ঞানই শক্তি। অজ্ঞানতাই সর্ববিধ দুঃখের মূল উৎস। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য গ্রন্থাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইমরান মাহফুজ : কবি, গবেষক