ক্যাসিনো অর্থনীতি: প্রয়োজন আছে না নেই

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

ক্যাসিনো—সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বেশ আলোচিত বিষয়। বিষয়টির ব্যাপক বিস্তৃতি রীতিমতো সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতির যে বেশ বড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থনীতি, সমাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুভূতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ক্যাসিনোর প্রভাব নিয়ে অলোচনা এবং গবেষণা হতে পারে, হওয়া প্রয়োজনও। বিশ্বজুড়ে ক্যাসিনো অর্থনীতিও অনেক বড়। যাহোক, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ‘ক্যাসিনো অর্থনীতি’ নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অর্থনীতি এবং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব একটু ভেবে দেখা যাক।

ক্যাসিনো অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা বাহুল্যতা, এটি এখন সবার কাছে পরিচিত বিষয়। সরাসরি তাই মূল প্রসঙ্গে যাওয়াই উত্তম। ক্যাসিনো অর্থনীতির সঙ্গে তারল্য বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন অর্থনীতিতে নগদ অর্থপ্রবাহের সংকট দেখা দেয়, তখন তাঁকে তারল্য–সংকট বলে। তারল্য হলো যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের মূল চালিকা শক্তি। বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন হাতে নগদ অর্থ রাখেন। তাই কাসিনো অর্থনীতির আকার বাড়লে হাতে নগদ অর্থ রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য–সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী। ক্যাসিনোতে ওভারনাইট বেশ বড় ধরনের ক্যাশ ইন ফ্লো এবং আউট ফ্লো ঘটে, যা মানি মার্কেটকেও কিছু অস্থিতিশীল যে করে না, তা বলার নিশ্চিত উপায় নেই এবং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তারল্যের গতিপ্রবাহে এর ভূমিকা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, যদিও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্যাসিনো অর্থনীতি তারল্য–সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, কিন্তু এটি আবার মানুষের হাতে বাজার অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়! এর প্রভাবে মানুষের কাছে যখন ‘ক্যাশ ইন হ্যান্ড’ বেড়ে যায়, তখন মুদ্রাস্ফীতি (কোনো কাল পরিধিতে পণ্যসেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে গেলে অর্থনীতির ভাষায় তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। সাধারণত পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ওই পণ্য ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে আগের পরিমাণ পণ্য কিনতে গেলে পরিমাণে কম পাওয়া যায়) বেড়ে যায়, সহজভাবে বললে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এটি পুরো দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া নগদ অর্থের জোগান পেতে ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন চাঁদাবাজির মতো ঘটানায় জড়িয়ে পড়ে, যা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রও ক্যাসিনোর ঋণাত্মক ভূমিকা লক্ষ করা যায়। অবৈধভাবে যদি ক্যাসিনো হয়, তবে এর অর্থনৈতিক ভয়াবহতা অবশ্যই উদ্বেগজনক হবে। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাসিনো অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ আব্যশক।

তৃতীয় যে বিষয়টি, তা হলো মানি লন্ডারিং। (মানি লন্ডারিং হলো একটি অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে সেই সম্পদের আংশিক বা পূর্ণ অংশ রূপান্তর বা এমন কোনো বৈধ জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়, যাতে করে সেই বিনিয়োগকৃত সম্পদ থেকে অর্জিত আয় বৈধ বলে মনে হয়, তাকে মানি লন্ডারিং বলে)। ক্যাসিনো ব্যবসা বা খেলায় কালোটাকার ব্যবহার সর্বাধিক। ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত কালোটাকাকে সাদা করার জন্য, কর প্রদান এড়াতে, তারা বিভিন্ন উপায়ে (যেমন এই অর্থ দিয়ে জমি ক্রয়, বাড়ি বা গাড়ি ক্রয়, শেয়ার ক্রয় ইত্যাদি) টাকাকে বিনিয়োগ করে; যা মানি লন্ডারিং কার্যক্রমে মুদ্রা পাচার জড়িত। এভাবেই ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাসিনো যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বিদ্যমান, তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচারের পথটি বেশ প্রশস্ত।

ক্যাসিনো অর্থনীতির সঙ্গে এ ছাড়া আরও অনেক অপরাধমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত রয়েছে। সুতরাং ক্যাসিনো অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি বা বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়া আমাদের অর্থনীতির জন্য শুভকর নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যাসিনো অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে আইনগতভাবে ও প্রতিষ্ঠানিকভাবে, অফ-সাইট এবং ইন-সাইট সুপারভিশনের মাধ্যমে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

*সাকিব জামাল, ব্যাংকার