জাহাজভাঙা শিল্পে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না

জাহাজভাঙা কারখানা পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
জাহাজভাঙা কারখানা পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প। ষাটের দশকে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয় আশির দশকে। ১৫০টির বেশি ইয়ার্ডের রেজিস্ট্রেশন থাকলেও সক্রিয় ইয়ার্ডের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০। এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক জড়িত এবং আরও প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ পরোক্ষভাবে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।

বিদেশি পুরোনো ও অচল হয়ে যাওয়া জাহাজ উপকূলে টেনে এনে এখানে ভাঙা হয়। একটি শ্রমঘন ও দুর্ঘটনাপ্রবণ শিল্প। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে এখানকার ইয়ার্ডগুলোয় বড় জাহাজ কাটা সুবিধাজনক হওয়ায় বিশ্বের অনেক বড় জাহাজ এখানেই কাটা হয়। কিন্তু বড় জাহাজ কাটার জন্য যে ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অপরিহার্য, এখানে তা ব্যবহার করা হয় না। এর মূল কারণ মালিকেরা চান কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা। জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকেরা টাকার পাহাড় গড়লেও শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো বিষয় মালিকপক্ষের কাছে কখনোই গুরুত্ব পায়নি।

জাহাজ কাটার আগে বর্জ্য, বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরকমুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কমপক্ষে ৩২ জন এবং ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ইতিমধ্যে ১৪ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, যা অতীতের সব রেকর্ডকে ভঙ্গ করেছে। বছরের পর বছর জাহাজভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

বাংলাদেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুবিধাও জাহাজভাঙা শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না। ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী, এ খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসে ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা ধার্য হয়েছে। মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ কার্যকর করা শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক হলেও মালিকেরা তা মানছেন না। শ্রমিকেরা এখনো দৈনিক মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও কোনো ওভারটাইম ভাতা দেওয়া হয় না। উৎসব বোনাস হিসেবে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়, যা শ্রমিকদের দারিদ্র্যের সঙ্গে চরম উপহাস ছাড়া কিছুই নয়। অনেক ইয়ার্ডে সময়মতো মজুরিও পাওয়া যায় না।

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

শ্রমিকেরা ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে কাজ করেন। এ কারণে এখানে সবেতন ছুটির প্রচলন নেই। অস্থায়ী ভিত্তিতে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে বিধায় শ্রমিকেরা আহত বা নিহত হলে অনেক নিয়োগকর্তা শ্রমিকদের দায় নেন না। শ্রমিক সংগঠন, প্রচারমাধ্যম ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নানাবিধ তৎপরতার কারণে বিষয়টি বিভিন্ন মহলের দৃষ্টিগোচর হলেও দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হওয়ার মিছিল যেন থামছেই না। এমনিতেই জাহাজভাঙা শিল্পে কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তারপরও ইয়ার্ডের মালিকেরা নিজেরা সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ না করে অধিক মুনাফার লোভে ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাজ করান। এসব ঠিকাদার কেবল ‘মুনাফা বোঝে, মানুষ বোঝে না’, তাই ঝুঁকি নিরসনে কোনো ব্যবস্থা তাঁরা নেন না। এমনকি শ্রমিকদের ন্যূনতমভাবে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয় না। এ কারণে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই শ্রমিকেরা বছরের পর বছর কাজ করে চলেছেন। রাতের বেলায় ইয়ার্ডে কাজ না করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও মালিকেরা তাও মানছেন না।

দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হওয়াকে শ্রমিকেরা নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। কাজে যোগদানের পর তাঁদের নিরাপদে সুস্থ শরীরে বাসায় ফেরার নিশ্চয়তা নেই। চোখের সামনে সহকর্মীদের মৃত্যুযন্ত্রণা বুকে চেপে ধরে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। পুরোনো পরিত্যক্ত জাহাজ রিসাইক্লিং–সংক্রান্ত ২০০৯ সালের হংকং কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, প্রতিটি পরিত্যক্ত জাহাজ বর্জ্যমুক্ত করে রিসাইক্লিং করতে হবে। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে বিষয়টি জাহাজ বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউ আমলে নিচ্ছে না। এ কারণে পরিত্যক্ত জাহাজে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ, যেমন: সিসা, পারদ, ক্রোমাইটস ও এসবেস্টস পরিবেষ্টিত পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বিধায় তাঁদের ফুসফুসের নানাবিধ জটিল রোগসহ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও ধারণা করা যায়, সংখ্যাটি নেহাত কম হবে না। এত নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়েও এখানে কাজ করার কারণ, তাঁরা আর্থিকভাবে অত্যন্ত অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত দুর্বল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাঁদের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। জীবনের তাগিদে কাজ করতে আসা এসব হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে কোনো বিকল্প না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে এই পেশাকেই বেছে নিয়েছেন। বছরের পর বছর এই সুযোগই নিচ্ছে মালিকপক্ষ। দুর্বল, নিপীড়িত ও অসহায় জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রেরও যেন কোনো দায় নেই।

তীব্র নিরাপত্তার শঙ্কা এবং নির্যাতনের পরেও অসহায় শ্রমিকগুলো নিরলস পরিশ্রম করে জাহাজভাঙা শিল্পকে একটি মজবুত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে জাহাজভাঙা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় রড ও ইস্পাতশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বড় অংশ জোগান দেওয়া হয় এই শিল্প থেকে। ফলে, এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় স্টিল ও রিরোলিং মিল। এ ছাড়া ভাঙার জন্য আনা জাহাজগুলোয় অনেক পুরোনো ভালো ও উন্নত মানের আসবাবপত্রসহ বহু মূল্যবান গৃহস্থালিসামগ্রী পাওয়া যায়। গৃহস্থালিসামগ্রী বিক্রির জন্য এখানে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের এই শিল্প আজ সমগ্র বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ জাহাজভাঙা শিল্প হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

শত বাধা ও নিরাপত্তার শঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া শ্রমিকের জীবনই যদি প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে থাকে, তাহলে তা কখনোই শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য সুখকর হতে পারে না। বরং পুরো শিল্পই গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে বলা যায়। জাহাজভাঙা শিল্পকে রক্ষা ও টেকসই করার স্বার্থে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল এখনই থামাতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ শিপইয়ার্ড।

* ফজলুল কবির মিন্টু, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা