আমার শিক্ষক আমার অনুপ্রেরণা

বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি! কারণ, বাবা আমাকে চার বছর বয়সে রেখে চলে যান না ফেরার দেশে। তবে আমার মা ও বোনদের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।

আমার পাঁচ বোন, তিন ভাই। পেশায় চারজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে দুজন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। বাকি দুজন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বড় ভাই মো. জসিম উদ্দিন। পেশায় আইনজীবী। আমার আজন্ম চলার পথের শিক্ষক তিনি। আমার অনুপ্রেরণা, আমার অনুভূতি, আমার বিশ্বাস—সবকিছুই তাঁকে ঘিরে। এ পর্যন্ত যত দূর পৌঁছেছি, তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

১.
আমার প্রি-প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা মূলত আমার বোনদের হাত ধরেই! শিশু শ্রেণিতে বড় বোন সেলিনা বেগমের হাত ধরে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন ২০০৩ সাল। শিশু শ্রেণিতে থাকতে আমাদের পড়াতেন রিনা নামের একজন শিক্ষিকা। মূলত এক ঘণ্টা স্কুলে থাকতাম। বাকি সময় পড়তাম আমার বোনদের কাছে।

২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম সিলেটের স্থানীয় মীর মহল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু। তখন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি শাহানা ম্যাডাম, রোজিনা ম্যাডাম, দিদিমণি, হাবিব স্যার, হাবিবুল্লাহ স্যার (প্রধান শিক্ষক), আবদুল্লাহ স্যার ও কাদির স্যারকে। পাঁচ বছর কাটিয়েছি প্রতিষ্ঠানটিতে। অনেক দুষ্টু ছিলাম। এ কারণে কান-মলাই, নীল ডাউন ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।

দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে ক্লাস ফাইভে উঠে গেলাম, তা বুঝতে পেলাম না। বুঝতে পেলাম যখন সমাপনী পরীক্ষা চলে আসছিল। তখন আমার প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্যারদের ভালোবাসা দেখেছিলাম। বৃত্তি পরীক্ষার দিন সকালে আবদুল্লাহ স্যার খোঁজ নিতে এসেছিলেন বাসায়। কতটুকু মমত্ববোধ থাকলে এ রকম অনুভূতি মানুষের জীবনে আসে। সে যা-ই হোক, সেবারের বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। যার কৃতিত্ব আমার শিক্ষকদের ও আমার পরিবারের সদস্যদের। আরেকজন মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছি; যিনি পেশায় এখনো শিক্ষক। তিনি আমার বড় ভাবি। চলার পথে ওনার অবদানও কম নয়। আরেকজন মানুষ এখনো গ্রামে গেলে খোঁজ নেন। তিনিও পেশায় শিক্ষক। নাম দিপু চন্দ্র। ওনার সংস্পর্শও কম পাইনি।

২.
প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে মায়ের হাত ধরে ভর্তি হই গ্রামের পার্শ্ববর্তী বানিয়াচং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। তখন কিছু ভালো মানুষ ও ভালো শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম। তাঁদের মধ্যে ফয়সল স্যার, বিপুল স্যার, সূচিত্রা ম্যাডাম, রব্বানী স্যার অন্যতম। এই মানুষদের তত্ত্বাবধানে কাটিয়েছি মাধ্যমিক জীবনের পাঁচটি বছর। যত রকম দুষ্টুমি করেছি, তা থেকে রক্ষা করে দিতেন আমার ফয়সল স্যার। এই মানুষটি আমাকে এত বুঝতেন যে পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে কেমন জানি সহজ মনে হতো। মাঝেমধ্যে শাস্তিও ভোগ করেছি। স্যারদের অনুপ্রেরণায় বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতাসহ নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। প্রাপ্তির ঝুড়ি হয়তো শূন্য। কিন্তু স্যার-ম্যাডামদের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা সারা জীবনের জন্য আমাকে ঋণী করে রেখেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমি আরেকজন শিক্ষক পেয়েছি। তিনি আমার বড় দুলাভাই মো. কামাল উদ্দিন। তিনিও শিক্ষক। বিজ্ঞানের জটিল জটিল সমাধান ওনার কাছ থেকে পেয়েছি।

৩.
স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হই উচ্চশিক্ষার জন্য স্থানীয় বানিয়াচং আইডিয়াল কলেজে। সেখানে গিয়ে আমার স্বপ্নের দ্বার খুলে গিয়েছে। পেয়েছি কিছু মনের মতো শিক্ষক। মানবিকের ছাত্র হলেও সমানতালে ভালোবাসা পেয়েছি বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার স্যার-ম্যাডামদের কাছ থেকে। দারুণ কিছু সময় পার করেছি আমার শিক্ষকদের সঙ্গে। ম্যাগাজিন সম্পাদনা থেকে শিক্ষাসফরের কাজ—সবই আমার শিক্ষকদের সঙ্গে করেছি। কলেজজীবনে যাঁদের সংস্পর্শে কেটেছে, তাঁদের মধ্যে পূর্ণিমা ম্যাডাম, জসিম স্যার, কাকলি ম্যাডাম, অরূপ স্যার, দ্বিজয় স্যার অন্যতম। বাকি শিক্ষকদেরও ভালোবাসা পেয়েছি। তবে তাঁরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাকে যদি বলা হয়, তোমার কলেজজীবনের প্রিয় শিক্ষক কে? তাহলে আমি এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই দিতে পারব না। কারণ, কাকে রেখে কাকে বলব! কারও অবদানই যে কম নয় আমার জীবনে।

আমি চরম মিস করি আমার এসব শিক্ষককে। মিস করি তাঁদের লেকচারগুলো। মিস করি তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো। এই কলেজ আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। বিনিময়ে এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি প্রিয় কলেজের জন্য। কলেজের প্রতিটি ইট, বালু, পাথর, গাছ, বেঞ্চ, টেবিল, হোয়াইট বোর্ড, মাইক্রোফোনের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। এগুলো আমাকে এখনো ভীষণ টানে। আমার জীবনে কিছু সেরা শিক্ষক পেয়েছি এই প্রতিষ্ঠানটিতে; যাঁরা আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। একবারের জন্যও মনে হয়নি তাঁরা আমার শিক্ষক! তাঁরা সব সময় আমার কাছে ছিলেন বন্ধুর মতো। তাঁদের ভালোবাসা, শাসন আমায় আলোর পথ দেখিয়েছে। তাঁদের সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে আজ হয়তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারতাম না। কলেজে প্রতিটি অনুষ্ঠানে কাজ করেছি স্যার-ম্যাডামদের সঙ্গে। কলেজের অনুষ্ঠান হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা তুলতাম। এসব কেবলই এখন স্মৃতি।

একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের প্রতি কতটুকু আন্তরিক হলে সেই ছাত্রকে রাত দুইটায় কলেজের কাজ শেষে বাড়ি পৌঁছে দেন? একজন শিক্ষিকা কতটুকু আন্তরিক হলে তাঁদের ছাত্রকে সকালের নাশতার জন্য নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেন। একজন শিক্ষিকা কতটুকু আন্তরিক হলে তাঁর ছাত্রকে রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে রিকশায় বসিয়ে কলেজে একসঙ্গে আসেন! একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী শিক্ষক কতটুকু আন্তরিক হলে তাঁর মুসলিম ছাত্রকে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে ইফতার করাতে পারেন। এসব আন্তরিকতা আমি আমার এই ভালোবাসার জায়গাই কেবল পেয়েছি। কলেজটির সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। স্যার-ম্যাডামদের এসব ভালোবাসার কারণেই আমি নিয়মিত কলেজে যেতাম। একধরনের আলাদা ভালো লাগা কাজ করত। ক্লাসে মাঝেমধ্যে দুষ্টুমিও করতাম। আমার জন্য বন্ধু তাপস কতবার জসিম স্যারের বকুনি ও শাস্তি পেয়েছে, তার হিসাব কেবল তাপসই জানে। তবু আমাদের সম্পর্কের কোনো দিন ফাটল ধরেনি।

৪.
বর্তমানে পড়াশোনা করছি দেশের সপ্তম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে। যেটি সংক্ষেপে এমসি কলেজ নামে পরিচিত। এখানেও অনেক দারুণ দারুণ শিক্ষকের সংস্পর্শ পাচ্ছি। মানবিকতার শিক্ষা, ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা এখান থেকেই রপ্ত করছি বেলা শেষে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন শিক্ষক আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছেন। সবার প্রতি আজন্ম কৃতার্থ।

পৃথিবীর সব শিক্ষক ভালো থাকুন। শ্রদ্ধা। ভালোবাসি। রবার্ট স্টার্নবার্গের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করতে চাই, There is no recipe to be a great teacher, that's what is unique about them.