এই মৃত্যুপুরী আমাদেরই

আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: প্রথম আলো
আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: প্রথম আলো

এমন দেশ, এমন বিদ্যাপীঠই কি আমরা চেয়েছিলাম। জাতির সূর্যসন্তানেরা, যাঁরা এই মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছেন, আমাদের আজকের পরিণতি দেখে তাঁরা কি ভালো আছেন! এ দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজ—সে বিষয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রতিটি মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন এমন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে, ভালো চাকরি পাবে, দেশের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কিছু করবে। প্রতিটি স্বপ্নেরই বুঝি একটা দাম থাকে! সে দাম যদি কখনো সাধ্য ও সীমার অধিক হয়ে যায়, তবে সে স্বপ্ন পূরণ অথবা অপূর্ণতায় কিছু কি যায় আসে!

একজন মা–বাবাকে এমন কোনো স্বপ্নের মূল্য হিসাবে তাঁর প্রিয় সন্তানকে বিসর্জন দিতে হয়, ভাইকে তার ভাই, বন্ধুকে বন্ধুরা হারিয়ে ফেলে তখন সেই স্বপ্ন মূল্য হারিয়ে ফেলে, বিবর্ণ হয়। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে সবাইকে পোড়ায়। ছোট্ট একটি ঘটনাও কখনো কখনো পুড়িয়ে ফেলে অনেক বড় কিছুকে; আবরার ফাহাদদের মৃত্যুগুলো পোড়ায় পুরো ক্লাস, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়, পুরো ছাত্রসমাজ, পুরো সমাজ, পুরো ব্যবস্থা তথা পুরো দেশকেই।

আমি বিশ্বাস করি না, এমন শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে আসা কেউ তাঁর সহপাঠী, ছোট ভাই অথবা বড় ভাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারেন। আবরারকে তাঁর বুয়েটে পড়া সিনিয়ররা, তাঁর ভাইয়েরা মারেননি, মারতে পারেন না। তাঁকে মেরেছে ক্ষমতার জলীয়বাষ্পে ভেসে থাকা নিজেকে হারিয়ে ফেলা কিছু ঘোরগ্রস্ত মানবসন্তান। অথচ সে ছেলেগুলো কিন্তু এসেছিল স্বপ্ন নিয়ে, প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে। তাঁদের প্রত্যেকেরই বাবা আছে, মা আছে, ভাইবোন আছে, ঘরবাড়ি স্বপ্ন আছে। তাঁরাও এসেছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করে মানুষ হতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁরা শিক্ষার্থী হত্যা মামলার আসামি।

আবরারের মা-বাবা, তাঁর সহপাঠীরা গুমরে কাঁদছেন, পুরো দেশ কাঁদছে তাঁর মৃত্যুশোকে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবেছে, যাঁরা আবরারকে মেরে ফেলল, তাদের মা-বাবার কথা! আবরার হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁরা সবাই বুয়েটের ছাত্র। তাঁরাও জীবনের বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। যেদিন তাঁরা বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন, সেদিন নিশ্চয়ই তাঁদের চোখের মণিতেও স্বপ্ন খেলা করেছে। তাঁরাও নিশ্চয়ই কারও না কারও চোখের মণি। তাঁদের মা–বাবা, ভাইবোন, সমাজ–সংসার আছে। আজ তাঁদের মা-বাবা পুত্রের এমন কুকর্মে কি ভীষণ গর্বিত বোধ করছেন। নাকি তাঁরা পুত্রের অপরাধে নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। লজ্জায়, হতাশায়, অবমাননায়, আবরারের মা-বাবার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাঁদের। আবরারের মা-বাবার কান্না কি হত্যা মামলার আসামি সন্তানদের মা-বাবারও বুকফাটা কষ্টের কান্নার দমক তুলছে না। আবরারের মা-বাবা ছেলেকে যেমন হারিয়ে ফেলেছেন, হত্যায় অভিযুক্ত ছাত্রদের মা-বাবাও কি তাদের নিজ নিজ সন্তান হারিয়ে ফেললেন না। মৃত ব্যক্তির মা-বাবা থেকে অভিযুক্তদের মা-বাবার এই হারানোটা, তাঁদের পরাজয়টা কি কোনো অংশেই কম? আমরা হয়তো অনেকে আবরারের মা-বাবার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। এই ছেলেগুলোর মা-বাবার জায়গায় কি আমি–আপনি হতে পারতাম না। এই কষ্টটা কি সহ্য করার কষ্ট। মিডিয়াতে শুধু আবরারের মা-বাবাকে দেখানো হচ্ছে, তাঁদের বেদনা আমরা দেখছি। হত্যায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মা-বাবাকেও দেখানো হোক, মানুষ দেখবে তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ব্যর্থতার গ্লানি, ভয়ানক বেদনা–বিভীষিকা। কোনো সন্তান একজন হত্যাকারী হিসেবে তার মা-বাবার জন্য কতটা পরাজয় বয়ে আনে, কতটা হারিয়ে দেয় সেটা অনুধাবন করতে পারলে, কারও পক্ষেই কি সম্ভব কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করা!

পুরো দেশটার যা কিছু, সবই তো আমার আর আমাদের। যাঁর মৃত্যু হলো, যাঁরা মারলেন, যে মরবেন, যে মারবেন সবাই আমারই। কিন্তু এমন মৃত্যু উপত্যকা কি চেয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। এমন স্বাধীনতার জন্যই কি তাঁরা হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তবু কেন এমন হচ্ছে, কী করে এমন হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখলে থাকবে ক্ষমতাসীনদের হাতে। হল প্রশাসন নয়, সিট বরাদ্দ করবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা! যাঁরা পড়াশোনা করতে এসেছিলেন একে একে তাঁরা এক অর্থে হয়ে উঠবেন ক্যানটিন, লাইব্রেরি, আবাসিক হল, এমনকি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইজারাদার। তাঁদের শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একজন শিক্ষার্থী হলে রুম পাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবেন! তাঁরা যেভাবে চাইবেন সাধারণ ছাত্ররা সেভাবে চলতে বাধিত থাকবেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এমন কোনো প্রাণী এই পৃথিবীতেই থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলবে তাঁদের ইশারায়। এমন যদি হয়, মানুষ তো জন্মগতভাবেই ক্ষমতার পূজারি, প্রভুত্ব করতে চায়।

প্রশ্ন হলো, যাঁরা জীবনে বহু প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ ও উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আসছেন তাঁদের ক্ষমতার স্বাদ দেওয়া বা ক্ষমতার কেন্দ্রমুখী করার যৌক্তিকতা কোথায়। যাঁরা পড়াশোনা করতে এসেছেন, নিজেকে মানুষরূপে গড়ে তুলতে এসেছেন, তাঁরা কেন পড়াশোনা বাদ দিয়ে ক্ষমতার লালনপালন চর্চা করবেন! কেনই তাঁরা নেতাদের রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের পুতুল হবেন, হবে ক্ষমতার শীর্ষারোহনের মুখ্য হাতিয়ার! আমরা বারবার একটা ভুল বোধ হয় করছি, রাজনীতি ও ক্ষমতা দুটো বিষয়কে এক করে মিলিয়ে ফেলছি। আদৌ কি রাজনীতি থাকতে হলে ক্ষমতার থাকাটা জরুরি!

মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে
মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে

ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি করবেন। কেন করবেন না! এই দেশের ইতিহাস গঠনে, দেশ গঠনে ছাত্ররাজনীতি, ছাত্ররা ছাড়া আর কোনটি, আর কে এত বড় ভূমিকা রেখেছিল! এই জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছাত্ররাজনীতি করেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের সামনে ছাত্ররাজনীতির মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, আদর্শ ছিল, দেশের জন্য, জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল। তাঁরা সেটা পালন করেছেন নিজের সবটুকু দিয়ে, নিজেদের উৎসর্গ করে। কোনো ছাত্রকে এই মুহূর্তে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কেন ছাত্ররাজনীতি করছেন। শতকরা ৯৯ ভাগ ছাত্রই উত্তর দেবেন আদর্শ প্রতিষ্ঠা, দেশের প্রয়োজনে। কিন্তু এই ৯৯ ভাগ ছাত্র বুকে হাত দিয়ে কি সত্যকে অস্বীকার করবেন, বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি যতটা না আদর্শ আর দেশের জন্য, তার থেকে ঢের বেশি নিজ স্বার্থ, দল আর দলের নেতার জন্য।

ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন অবশ্যই ফুরিয়ে যায়নি। এই রাজনীতি হতে হবে ছাত্রদের অধিকার রক্ষায়, মানুষের সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায়। ছাত্ররাজনীতি কেন কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে, ছাত্ররা কেন মিছিল নিয়ে কারও রাজনৈতিক সমাবেশে যাবে। তারা মিছিল করতে হলে করবে, সমাবেশ করবে— নিজেদের জন্য, নিজের অধিকার রক্ষায়। ছাত্রসংগঠনগুলো কেন কারও হাতিয়ারে পরিণত হবে। আমি বিশ্বাস করি, অনেকেই একমত হবেনও, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ অবশ্যই তিনি রাজনীতি করতেন, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন, সোচ্চার হতেন। যেমনটি তিনি করেছিলেন ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনের সময়। ভাষার জন্য আন্দোলনে সেই পঞ্চাশের দশকে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কারাবরণ ও কারাভোগ করেছেন। আজ বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো রাজনীতি করতেন সাধারণ ছাত্রদের অধিকার ও দাবি আদায়ে, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার রক্ষায়। অন্ধভাবে কোনো দলকে সমর্থন, কোনো নেতাকে সেবা দেওয়ার জন্য, নিজেকে ক্ষমতার বলয়ে সম্পৃক্ত করে কিছু সুবিধা গ্রহণ, চাঁদাবাজি, সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য জাতির পিতা তো কখনো রাজনীতি করেননি। আজ তিনি থাকলে এমন ছাত্রহত্যার রাজনীতি কোনোভাবেই বরদাস্ত করতেন না। কাউকে সেটি করতেও দিতেন না। বিষয়টি আসলে তেমনটিই তো হওয়া উচিত।

ছাত্ররা রাজনীতি করবে না কেন অবশ্যই করবে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে কেন তা করতে হবে! বরং তাদের রাজনীতি হওয়া প্রয়োজন — রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার, বিরোধী দল, তাদের যেকোনো অনৈতিক কার্যক্রম, অন্যায়, অনাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে, তাদের জন্য জবাবদিহির প্রকৃত ক্ষেত্র তৈরি করতে। নিজের গায়ে রং মাখানো ছাত্রাবস্থায় কেন, সে রাজনীতি হোক দেশের আপামর জনসাধারণের জন্যে একজন স্বতন্ত্র শক্তিশালী সাধারণ মানুষ হয়ে, সাধারণের কাতারেও অনন্যসাধারণ হয়ে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক