ডাক জাদুঘর নেবে রানারের ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজার সময়ে
একুশ শতকে ইন্টারনেট-ইমেইল ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত চিঠির ব্যবহার হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন আর নেই কোনো চিঠির আদান-প্রদান। এ প্রজন্মের শিশুদের কাছে হাতে লিখে চিঠি আদান-প্রদান করার বিষয়টি অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই। আজকালের শিশু-কিশোরদের কাছে চিঠি, ডাকবক্স, রানার বা ডাকপিয়ন এমন বিষয়গুলো যেন শুধুই বইয়ের পাতায় রয়েছে।
ডাকঘর থাকলেও আগের মতো নেই চিঠির ব্যবহার, দেখা যায় না চিঠি হাতে ডাকপিয়নকেও। আর চিঠি বা ডাকঘর সম্পর্কে জানতে বা দেখতে হলে শিশুদের যেতে হবে জাদুঘরে। ডাক জাদুঘরের কথাই বলছি, যেখানে ডাক বিষয়ক ঐতিহ্য-ইতিহাস রয়েছে। যেখানে দেখা মিলবে, চিঠি, ডাকবাক্স, রকমারি ডাকটিকিট, চিঠি পাঠাতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, রানার বা ডাকপিয়ন, তাদের ব্যবহৃত পোশাক ইত্যাদি।
৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস পালন করা হয়। দিবস টি নিয়ে নানান আয়োজন থাকে দিনভর।
বাংলাদেশ ডাক জাদুঘর বাজধানীর গুলিস্থানে (জিপিও এলাকা হিসেবে পরিচিত) ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠিত ১৯৬৬ সালে। নানা সময়ে ডাক বিভাগের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি স্থান পেয়েছে জাদুঘরে।
ডাক জাদুঘরে দেখা যাবে, ডাক বিষয়ক বেশ কিছু দুর্লভ-দর্শনীয় বস্তু যা আপনাকে বিমোহিত করবে। যা এই ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে আপনাকে নিয়ে যাবে রানারের ঝুমঝুম ঘন্টা বাজার সময়ে।
মূল পোস্টাল জাদুঘরের এক হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের কক্ষটিতে প্রবেশ করতেই হাতের বা পাশে দেখা গেল রানারের অবয়ব মুর্তি। পরনে উর্দি, বর্শা ও লন্ঠন হাতে, কাধে চিঠির ব্যাগ। মনের ভেতরে কবি সুকান্ত ভট্রাচার্য গেয়ে ওঠেন, রানার ছুটছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে, রানার চলছে, খবরের বোঝা হাতে। আর ডানে লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ডাকটিকিট। পাশেই বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা চিঠি এখানে সংরক্ষিত আছে। পুরো গ্যালারি ঘুরে দেখা গেল, বিশ্বের ডাকবিভাগের ইতিহাসের পাশাপাশি বিশ্বসভ্যতায় বিবর্তনের নানা অংশ। দেয়ালে দেয়ালে রক্ষিত আছে ডাক বিভাগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের তেলচিত্র।
কালজয়ী নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র থেকে শুরু করে মহাকবি কায়কোবাদ, ডাকটিকেটের উদ্ভাবক স্যার রোনাল্ড হিল, সি ভি রমন, হেনরি ভন স্টিভেন ও মন্টেগোমারিসহ আরও অনেকেই।
ডাক জাদুঘরে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমল থেকে শুরু করে এখনকার সময় পর্যন্ত প্রচলিত বিভিন্ন চিঠির বাক্স রয়েছে। এই জাদুঘরে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতিসংবলিত একটি চিঠির বাক্স রয়েছে, ওজন নয় মণ। এ চিঠির বাক্সটি তৈরি হয়েছিল ১৮৯০ সালে। ইংলেন্ডের বার্মিং হামের তৈরি সাত মণ ওজন করা যায়, এ রকম একটি স্কেল ছাড়াও হরেক রকমের আরও ১০ থেকে ১২টি স্কেল রয়েছে।
ডাক প্রহরীদের ব্যবহৃত ১৮৭০ সালের বর্শা, ব্যাগ, চামড়ার ব্যাগ, টুপি, পোশাক, ইংরেজ আমলের ধাতব স্ট্যাম্প প্যাড, ফ্রাংকিং মেশিন, ১৮৭৮ সালের টেবিলঘড়ি, দেয়ালঘড়ি রয়েছে। এ ছাড়াও পোস্টম্যান, হেড পোস্টম্যান ও অন্য ব্যক্তিদের ব্যবহৃত লণ্ঠন, বিউগল, তলোয়ার, বন্দুক, ডিমলাইট, চামড়ার ব্যাগ, মানিব্যাগ, ছুরি প্রভৃতির দুর্লভ সব সংগৃহীত রয়েছে, যা ব্রিটিশ আমলের ডাক ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে।
পোস্টাল জাদুঘরে পুরনো দিনের বহু রূপেরর বহু আকৃতির তালাচাবি, সিলমোহর, স্ট্যাম বক্স, পোস্টকার্ড, খাম, মোমের বাক্স, বিভিন্ন ধরনের টেলিফোন, ফ্যাক্স, অফিসিয়াল সার্কুলার এবং পৃথিবীর বিভন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত ডাক বিষয়ক প্রকাশনায় ভরপুর। রয়েছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রকাশনা ‘ডাক প্রবাহ’–এর বিভিন্ন সংখ্যাসহ বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থও। পুরনো দিনের বিভিন্ন মূল্যবান তথ্য সংবলিত বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ম্যাগাজিন সংরক্ষিত আছে এখানে। আর সেগুলো থেকে জানা যায়, বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষের ডাকঘরে ‘কুইনাইন’ রাখা হতো। এটি তখন ম্যালেরিয়ার ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকায় এই কুইনাইন ওষুধ একমাত্র ডাক বিভাগই মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতো। কারন, যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এ ডাক বিভাগ।
প্রথম সমুদ্র ডাক চালু হয় ১৬৩৩ সালে, প্রথম ডাক সার্ভিস ১৭৭৪ সালে, প্রথম স্ট্যাম প্রকাশ ১৮৪০ সালে, প্রথম রেলওয়ে ডাক সার্ভিস ১৮৩০ সালে, প্রথম মুদ্রিত খাম ১৮৩০ সালে, প্রথম পোস্টাল মানি সার্ভিস অর্ডার ১৮৩৮ সালে এবং প্রথম বিমান ডাক চালু হয় ১৯১১ সালে। জাদুঘর ঘুরে ঘুরে এ রকম আরও অসংখ্য তথ্য জানা যাবে।
জাদুঘরটি প্রথম ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করে ১৯৬৬ সালের ৯ অক্টোবর। সে সময় জাদুঘরটি ছিল ঢাকা জিপিও কাউন্টারের পাশেএকটি সাধারণ প্রদর্শনী। পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত চেষ্টায় জাদুঘরটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ১৯৮৫ সালে তা জিপিও ভবনের তৃতীয় তলার দুইটি কক্ষে স্থানান্তর করা হয়। যা ‘পোস্টাল মিউজিয়াম’ এবং ‘স্ট্যাম্প’ শাখায় ভাগ করা হয়েছে।
ডাক জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকতা মো. মোরশেদ আলম গত সোমবার বলেন, আগারগাঁওয়ে ডাক বিভাগের সদর দপ্তর নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। জাদুঘরের দুটি শাখার মধ্যে স্ট্যাম্প শাখাটি আগারগাঁও ডাক বিভাগের সদর দপ্তরে স্থানান্তর করা হচ্ছে। অন্য পোস্টাল শাখার যাবতীয় আপাতত এখানে রয়েছে। শিগগিরই তাড়াতাড়ি পুরো জাদুঘরটি সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
সরকারি ছুটির দিন ছাড়া বাকি সব দিন প্রতিদিনই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরের দুয়ার। কোনো প্রবেশমূল্য নেই। ডাক ভবনের তৃতীয় তলায় প্রশাসন শাখার পাশেই জাদুঘরটি অবস্থিত।