প্রশ্নের ভয়, ভয়ের রাজনীতি

বুয়েটে শেরেবাংলা হলের এই কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। ছবি: প্রথম আলো
বুয়েটে শেরেবাংলা হলের এই কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। ছবি: প্রথম আলো

লুটতরাজ ও জবাবদিহিবর্জিত রাজনৈতিক অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ভয়ের রাজনীতি। যেখানে দুর্নীতি বিস্তৃত হবে, অবাধ সম্পদ পাচার চলমান থাকবে, সেখানে নানা উপায়ে প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ ভয়ের আবহ রচিত হবেই, তার জন্য নিয়োজিত হবে লাঠিয়াল বাহিনী, এর কোনো শাখা রাষ্ট্রের পোশাক পরিহিত আর কোনো শাখা দেখতে আমজনতার মতোই। এমনই বাহিনী নিয়োজিত আছে সব পক্ষের ক্ষমতায় থাকাকালীনই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে। বিস্তৃত পেশির পলাশী শাখার ছাত্রসংগঠন নামের বাহিনীর সাম্প্রতিক শিকার আবরার ফাহাদ।

রাষ্ট্রের চুক্তি কিংবা সম্পদসংক্রান্ত বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উত্থাপন করার দায়ে আবরারের টুঁটি চেপে ধরে উচিত শিক্ষা দেওয়ার মহান দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল তাঁরই সহপাঠী লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। আফসোস, একটু বেশি ডোজ পড়ে যাওয়ায় ছেলেটা মরে গিয়েই হয়েছে যত শোরগোল। এখন ক্ষমতাসীন দল ‘কতিপয় দুষ্কৃতকারী’র ওপর সেই সব দায় চাপিয়ে দিয়ে আড়াল খুঁজছে, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই আবরারকে পিটিয়ে মেরেছে যে হাতগুলো, তাদের শক্তির উৎস বর্তমান কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামো।

পলাশী শাখার মতো বাড়াবাড়ি বাড়ছেই সর্বত্র, রাজধানীর যেকোনো ওয়ার্ড থেকে শুরু করে দূর প্রান্তের যেকোনো ইউনিয়নে, যেকোনো নতুন অথবা পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে রাস্তার ফুটপাত পর্যন্ত। সন্ত্রাস কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেই ‘স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে ঝাঁপিয়ে পড়া, ঝড়ের দাপট কোথাও কম, কোথাও বেশি। এই ভয়ের রাজনীতি, ত্রাসের আবহ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এই জাল বিস্তার সুপরিকল্পিত। নির্বাচনের আগে ও পরে নানা আইনি কাঠামো রচনা করে যেকোনো বিরুদ্ধ উচ্চারণের প্রতিকারের নানা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এরপরও মুখ বন্ধ রাখতে গলা চেপে ধরে কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করতে হয়। নইলে বিমুখ জনতা কখন প্রশ্ন তুলে বসে!

মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে
মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে

আবরারের মৃত্যুর পর আবার প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে, ছাত্ররাজনীতির নামে এই বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকতে দেওয়া হবে কি না? ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ প্রতিটি লাশের কফিনের সঙ্গেই ঘুরেফিরে আসে, আবার পরবর্তী লাশের অপেক্ষায় বাতাসে মিলিয়ে যায়। ‘মূলধারার ছাত্ররাজনীতি’র নামে গত কয়েক দশকে যা চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, তা মিনি মাফিয়াতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে ছাত্রসংগঠনগুলোর মূল কাজ নিজ নিজ শাখায় গায়ের জোরের আধিপত্য ধরে রেখে মিছিলে মাথার জোগান দেওয়া, বাহিনী সরবরাহ বজায় রাখা আর বিনিময়ে লুট দুর্নীতির ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা। স্বাধীনতার আগের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যের বয়ান দিয়ে এই তন্ত্র চালু রাখার সপক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, তা বাতিল করে দেওয়ার জন্য বিগত বছরগুলোর লাশের মিছিলই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কি এই লাঠিয়াল বাহিনী বিলুপ্ত করে দেবে? প্রশ্নই আসে না! সুতরাং অদূর ভবিষ্যতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ থেকে বের হয়ে আসার কোনো আশা নেই।

তাই আবরারের মুখকে ফোকাসে রেখে আমাদের তাকাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান এই পেশিশক্তির মূল উৎসের দিকে, এই ভীতিকর বাহুর পলাশী শাখার কিছু অভিযুক্ত আসামির বিচার চাওয়াতেই আলাপের সমাপ্তি নয়। প্রশ্ন করতে হবে, কেন এই ভয়ের রাজত্ব কায়েম, কেন জাতীয় কোনো স্বার্থ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা মানা? এই প্রশ্ন উত্থাপন কাদের স্বার্থের জন্য হুমকি? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রতীকী মিনি মাফিয়াতন্ত্র বিরাজ করছে, তার আসল শিকড় কোথায়?

আবরার হত্যার বিচার একটি নিতান্ত ফৌজদারি প্রক্রিয়া, যদিও এর সঙ্গে ন্যায়বিচারের প্রশ্ন জড়িত। সেই বিচার আমরা চাই, তা যত দীর্ঘই হোক। ন্যায়বিচার হলেও আবরার ফাহাদ ফিরবেন না, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলো বারবার উত্থাপন করা ও উত্তর খোঁজা আরও জরুরি। আমরা যদি মুক্তির পথ খুঁজি, তাহলে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই!

লেখক: উন্নয়নকর্মী