আবরার হত্যাকাণ্ড: নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

পেটানোর পর আবরার ফাহাদকে নিয়ে যাচ্ছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছবি: প্রথম আলো
পেটানোর পর আবরার ফাহাদকে নিয়ে যাচ্ছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছবি: প্রথম আলো

গত রোববার রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১৯ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কি বীভৎস, নির্মম, পাশবিক এ নিষ্ঠুরতা! এই হত্যাকাণ্ড আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমন শিকার শুধু যে আবরার ফাহাদই প্রথম তা নয়। এর আগে বুয়েটের সনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিম, ঢাকা মেডিকেলের আসাদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়েরসহ আরও কয়েকটি তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। তবে এর দায়ভার শুধু ছাত্ররাজনীতির কাঁধে চাপিয়ে দিলেই সঠিক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ, সর্বোপরি সবারই দায়ভার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে এর দায়ভার কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ, শান্ত, নিরিবিলি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জ্ঞানচর্চার স্থান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিতীয় নিবাস। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা হলে আজ তারা নিরাপদ নয়। হলে হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীর দৌরাত্ম্য চরম পর্যায়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলো নিয়ন্ত্রণ আর প্রশাসনের হাতে নেই। বিগত দুই দশকে যে দল ক্ষমতায় ছিল, তারাই মূলত হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। র‍্যাগিং তো প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গিয়েছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। হল প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। জেনেও হল প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে অপারগ কিংবা অনিচ্ছুক। বুয়েটের হলগুলোতে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আবরারকে রাত প্রায় নয়টার দিকে তার নিজের কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে টর্চার করা হয়। প্রায় দুইটার দিকে তাকে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়। এই পাঁচ ঘণ্টায় একটিবারের জন্য কি তার চিৎকারের শব্দ কারও কানে পৌঁছায়নি? হলে এতগুলো নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে, তারা প্রশাসনকে কি অবহিত করতে পারেনি? হলের প্রশাসন টর্চার সেলের বিষয়ে কি অবগত ছিল না? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর কি দিতে পারব আমরা?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির কর্মকাণ্ড মোটেও সাধারণ শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এত কিছুর পরও কেন প্রশাসনের নীরবতা বা উদাসীনতা? শুধু পদ-পদবি আঁকড়ে থাকার লোভ? প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলে হলে দায়িত্বরত প্রভোস্টের পদ চলে যেতে পারে—এই ভয়ে কেউ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। ছাত্রনেতাদের এসব অন্যায় কাজের প্রশ্রয় দিতে দিতে আজ তারা মাথায় উঠে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতেও কোনো শিক্ষার্থী সাহস পায় না। অভিযোগ না থাকলে হল প্রশাসনও নির্বিকারভাবে দিনাতিপাত করতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। এখন মাথা থেকে এই ভূত তাড়াবেন কী করে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক সরকার-সমর্থিত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই সাধারণত এসব পদে অধিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ দুই পক্ষেরই রাজনৈতিক আদর্শ একই। ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই অন্ধ রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এরই বলি হয়ে চলেছে আবরার, সনিরা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন উপাচার্য। এই উপাচার্য নিয়োগ দেশে কীভাবে হয় বা অতীতে হয়েছে, তা সবাই জানি। দলের প্রতি আনুগত্য দেখে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেক উপাচার্যের অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে শুরু করে যৌন কেলেঙ্কারি, এমন কোনো কাজ নেই যা পত্রপত্রিকায় উঠে আসেনি। এসবের প্রতিবাদ করা বিরোধী মতের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হেনস্তাও করেন কোনো কোনো ভিসি। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা গেছে। এসব অন্যায় কাজের সমর্থনের জন্য সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনকে প্রয়োজন হয়। ফলে অশুভ চক্রের একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়। একে অপরের অপকর্মের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। বুয়েটের উপাচার্য আবরার হত্যাকাণ্ডের ৩৯ ঘণ্টা পর ক্যাম্পাসে এসেছেন। আবরারের জানাজায়ও শরিক হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক হিসেবে সর্বাগ্রে তাঁর উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়ই ছিল।

বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবরার ফাহাদের কক্ষ। ছবি: প্রথম আলো
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবরার ফাহাদের কক্ষ। ছবি: প্রথম আলো

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ছাত্ররাজনীতি আর আগের অবস্থায় নেই। স্বাধীনতা-পূর্ব ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতির চিন্তাচেতনার সঙ্গে আজকের চিন্তাধারার কোনো মিল নেই। দেশের ক্রান্তিকালে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন, কিংবা ২০০৭-এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু গত এক দশকে বেশ কিছু জাতীয় ইস্যুতে ছাত্র আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আন্দোলন, কোটা আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সব কটিতেই সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই ছিলেন এই আন্দোলনের প্রাণবিন্দু। অর্থাৎ দেশের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই মূলধারার রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হওয়া ছাত্ররাজনীতি এখন প্রশ্নের সম্মুখীন! দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দাবির একটি হলো ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে, বুয়েটে তা বন্ধ হয়েছে।

ছাত্র-শিক্ষকদের এই অশুভ রাজনীতির উত্থান এক দিনে হয়নি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অশুভ রাজনীতির করাল গ্রাস আজ পরিলক্ষিত। সরকার-সমর্থিত রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক নেতারা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন। ক্যাসিনো ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, কর ফাঁকি, নদী দখল, ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ঋণ উত্তোলন, শেয়ারবাজারে দুর্নীতি, এমন কোনো কাজ নেই যেখানে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার প্রয়োজন হয় না। অসুস্থ এই রাজনীতিকে ব্যবহার করে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে অনেকেই। অতি অল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেকেই রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়ছে। সমাজের এত অনাচারের ছায়া পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। এ জন্যই তো কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বলেছেন, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ সমাজের এই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপরদিকে এও বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঠিক মূল্যবোধসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা যাচ্ছে না। এর দায়ভার শিক্ষকসমাজের যতটুকু, পুরো সমাজেরও দায় কোনো অংশে কম নয়।

ছাত্ররাজনীতি কিংবা শিক্ষকরাজনীতির বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পুরো সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হলে দলমত-নির্বিশেষে যোগ্য উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। হল প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ছাত্ররাজনীতির রাশ টেনে ধরতে হবে। ছাত্রসংগঠনের নেতা চয়নে ভালো ফলধারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে রাজনৈতিক দলকে। চাঁদাবাজি, মাদক কিংবা যেকোনো অন্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দলে স্থান না দিলেও কিন্তু সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নেতা তৈরি করতে হবে। জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে সচল রাখতে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে হলে বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নিজের দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। এই শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে একটি বার্তা সমাজে দিয়েছেন যে, সন্ত্রাস, দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তিরই দলে ঠাঁই নেই। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে কুপথে গমনকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই যাত্রা শুরু হোক।

ড. মো. আব্দুল মুহিত, সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাবি