বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ভোগান্তি কি শেষ হবে না?

এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়াটা অনেক কষ্টের। প্রথম আলো ফাইল ছবি
এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়াটা অনেক কষ্টের। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এইচএসসি পরীক্ষা পাসের পর সব শিক্ষার্থীর আকাঙ্ক্ষা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট থাকে শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দের তালিকায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই তাঁরা বিভিন্ন কোচিংয়ে ভর্তি হন। রাত-দিন পড়ালেখা করেন স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য। কোনো পরিবারের কোনো সন্তান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তখন ওই পরিবারকে গ্রামের মানুষ অন্য চোখে দেখে। পরিবারের সম্মান বৃদ্ধি পায় বহুগুণে।

আমার নিজের কথাই বলি। ১৭ বছর হলো বাবাকে হারিয়েছি। মা আমাকে তিলে তিলে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। আমি যেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, কী যে আনন্দ ছিল মায়ের চোখে–মুখে! ভর্তি হওয়ার পর যতবারই গ্রামে গিয়েছি, গ্রামের মানুষ আমাকে ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন। আমাদের পরিবারে, গ্রামে, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আমার মাকে আলাদা রকম গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলাগুলো আজও আমাকে ব্যথিত করে। আমরা উন্নত চিন্তা করতে পারছি না ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে।

সাধারণত, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার দুই দিন আগে শুরু করে। একবার ভাবুন তো পঞ্চগড়, নীলফামারী, কক্সবাজার কিংবা ঝিনাইদহের কোনো গ্রাম থেকে একটা শিক্ষার্থীদের ঢাকায় এসে পরপর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া কতটা কষ্টের। যদি পরীক্ষার্থী মেয়ে হন, তবে তো পরিবার তাঁকে নিয়ে আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে। কোথায় থাকবেন, নিরাপত্তা কেমন, অর্থের ব্যাপার তো আছেই। ধরেন, কোনো পরীক্ষার্থীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সিট মিরপুর আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিট ওই বিশ্ববিদ্যালের ক্যাম্পাসেই পড়ল, তাহলে এই দিনে একটা অচেনা মানুষের পক্ষে এই শহর কতটা ভোগান্তির হতে পারে, তা কি ভেবে দেখেছি? আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। একটি অসচ্ছল পরিবারের পক্ষে কি এত টাকা খরচ করা সম্ভব? আর পরিবার তো তাদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন থাকেই।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। অধিকাংশ ছাত্রীর সঙ্গে পরিবারের কেউ না কেউ এসেছেন। এতে তাঁদের অর্থের অপচয় হচ্ছে বহুগুণে। তার ওপর থাকা–খাওয়ার একটা চিন্তা তো আছেই! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনে দিনে ভর্তি ফরমের মূল্য বৃদ্ধি করছে। এটা আরও একটা আর্থিক চাপ দিচ্ছে কোনো কোনো পরিবারের ওপর। ভর্তি ফরম পূরণ থেকে শুরু করে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে একটা পরিবারের কত খরচ বহন করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তা জানে না? অথচ কিছু পরিকল্পনাই পারত অর্থ ও মানসিক কষ্ট দূর করতে।

একসঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
একসঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

পাকিস্তান শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বৈষম্য করেছে আমাদের সঙ্গে। তখন শিক্ষার হার ছিল ১৭ শতাংশ, কিন্তু বর্তমানে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করে শিক্ষার অমূল পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশেষ করে উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু তা আর সফল হয়নি। এ বছর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত পরীক্ষা নিচ্ছে, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সরকারও চাইচ্ছে এরপর থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়া হবে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষকমণ্ডলী এই উদ্যোগ ভেবে দেখতে পারেন। তাতে পরীক্ষার্থী ও পরিবারের সময় ও অর্থের অপচয় কমবে।

মো. শাহিন রেজা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়