লক্ষ্মীপুরের 'জমিদারবাড়ি' ও 'খোয়া দিঘি'র সংস্কার শুরু

লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার ‘জমিদারবাড়ি’টি সংস্কার করা হলে পর্যটকেরা আগ্রহী হবেন। ছবি: রাকিব হোসেন
লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার ‘জমিদারবাড়ি’টি সংস্কার করা হলে পর্যটকেরা আগ্রহী হবেন। ছবি: রাকিব হোসেন

মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ইতিহাস আরও পুরোনো। এর প্রমাণ জেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম দালাল বাজার ‘জমিদারবাড়ি’। প্রায় ২৫০ বছর আগে নির্মাণ করা জমিদারবাড়িটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশেই রয়েছে ইতিহাসবিজড়িত বিশাল এক দিঘি। নাম ‘খোয়া সাগর দিঘি’।

আইনি জটিলতা শেষে সম্প্রতি জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘির সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে।

‘জমিদারবাড়ি’টি অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে। ছবি: রাকিব হোসেন
‘জমিদারবাড়ি’টি অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে। ছবি: রাকিব হোসেন

ঐতিহাসিক নিদর্শন দুটি হতে পারে লক্ষ্মীপুরের সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। পরিকল্পিতভাবে সংস্কার করার মাধ্যমে দুটি নিদর্শনকে পর্যটকবান্ধব করা সম্ভব। জেলাবাসীর মধ্যেও এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে। অনেক দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকেরা এখানে আসেন। চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের ক্ষেত্রে নির্মাতাদের অনেকে এই স্থান পছন্দ করেন।

স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা নীরব অধিকারী বলেন, পুরোনো দিনের কাহিনি অথবা ভৌতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে জমিদারবাড়িটি খুবই উপযুক্ত। ইতিমধ্যে এখানে ‘মৃত্যু রূপ’ এবং ‘বিসর্জন’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য নাটকের শুটিং হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘি সংস্কার করলে শুটিং লোকেশন হিসেবেও সবাই পছন্দ করবেন।

পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যবাহী দালাল বাজার জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘিকে সংস্কারের মাধ্যেম পর্যটনের উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। এ জন্য বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসা উচিত। এতে দেশীয় পর্যটন সমৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের দারুণ সম্ভাবনাও রয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমিদারবাড়ি ও দিঘিটি রক্ষণাবেক্ষণ, পরিকল্পিতভাবে সংস্কার করা, পরিচালনার জন্য লোকবল নিয়োগ করা, সরকারিভাবে রেস্টহাউস নির্মাণ করা, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সব রকমের সুবিধাসহ যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া খোয়া সাগর দিঘিতে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা করলে স্থানটি পর্যটকদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

‘খোয়া সাগর দিঘি’র সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। ছবি: রাকিব হোসেন
‘খোয়া সাগর দিঘি’র সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। ছবি: রাকিব হোসেন

লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ‘দালাল বাজার’ যেতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা বাসে জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। বাজার থেকে প্রায় ২৫০ গজ পূর্বে ঢাকা-রায়পুর মহাসড়কের উত্তর পাশে খোয়া সাগর দিঘি। দিঘিসহ জমির পরিমাণ প্রায় ২২ একর। দিঘি বরাবার মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে জমিদার বাড়ির মঠ, স্থানীয়দের কাছে যা ‘মঠবাড়ি’ বলে পরিচিত। সেখান থেকে দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজের পেছন দিয়ে জমিদারবাড়ি যাওয়া যায়। হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। দালাল বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার প্রধান সড়কের পাশেই পুরোনো জমিদারবাড়িটির অবস্থান।

প্রায় পাঁচ একর জমির ওপর নির্মিত জমিদারবাড়িতে রয়েছে পরিত্যক্ত রাজগেট, রাজপ্রাসাদ, অন্দরমহল প্রাসাদ, শানবাঁধানো ঘাট, নাটমন্দির, পূজামণ্ডপ, বিরাটাকারের লোহার সিন্দুক, কয়েক টন ওজনের লোহার ভীম, বিশাল বাগান, জমিদারবাড়ির প্রাচীর প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে ছোট-বড় তিনটি পুকুর। দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকায় বিচার আসন ও নৃত্য আসনটি চুরি হয়ে গেছে।

‘খোয়া সাগর দিঘি’র সংস্কার করে পর্যটকদের আকর্ষণে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ছবি: রাকিব হোসেন
‘খোয়া সাগর দিঘি’র সংস্কার করে পর্যটকদের আকর্ষণে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ছবি: রাকিব হোসেন

স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে লক্ষ্মী নারায়ণ বৈষ্ণব নামের এক ব্যক্তি কলকাতা থেকে লক্ষ্মীপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতে আসেন। তাঁর উত্তর পুরুষেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক এজেন্সি এবং পরে জমিদারি লাভ করেন। ১৭৬৫ সালে সর্বপ্রথম লক্ষ্মী নারায়ণ বৈষ্ণবের নাতি (পুত্রের সন্তান) গৌর কিশোর রায় রাজা উপাধি লাভ করেন। সেই সময় ‘খোয়া সাগর’ নামক দিঘিটি খনন ও জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। তবে তৎকালীন স্থানীয় লোকেরা জমিদারদের ব্রিটিশদের ‘দালাল’ বলে আখ্যায়িত করেন। যেকারণে জমিদার বাড়িসংলগ্ন এলাকাটি দালাল বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার আগপর্যন্ত জমিদার বংশধরেরা এ অঞ্চলেই থাকতেন।

২০১৫ সালে দালাল বাজার জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। কিন্তু স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি উচ্চ আদালতে রিট করলে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ওই ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে জমিদারবাড়ি ও দিঘিটি ভোগদখল করে আসছিলেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ আগস্ট আদালত ‘জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘি’–সংক্রান্ত রিটটি খারিজ করে দেন। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রাচীন এই দুটি নিদর্শনের সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়। এদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি দালাল বাজার জমিদারবাড়ি–সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবেচনা করে দালাল বাজার জমিদারবাড়িকে সংরক্ষণযোগ্য ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে দালাল বাজার জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘি। সম্প্রতি আইনি জটিলতা নিরসন হয়েছে। প্রাচীন নিদর্শন দুটি সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, পরিকল্পিতভাবে দালাল বাজার জমিদারবাড়ি ও খোয়া সাগর দিঘিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এখান থেকে রাজস্ব আয়ের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে পর্যটকদের উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করেছে।’