কারা পকেটে পুরছে ময়লা-বাণিজ্যের ৪৫০ কোটি টাকা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা শহরে আমরা যারা থাকি তারা সবাই মোটামুটি জানি, রাস্তার বেহাল দশার পাশাপাশি আরেকটি জিনিস আমাদের প্রতিদিনের অস্বস্তি ও অস্বাস্থ্য বাড়ানোর জন্য দায়ী। সেটি হলো প্রায় এলাকার রাস্তায়ই জমিয়ে রাখা ময়লার স্তূপ। ঢাকায় যতগুলো মাঠ আছে, তার বেশির ভাগ এখন ময়লার সমুদ্র। আবর্জনার পসরা দেখলে আপনার মনে হবে কবি শামসুর রাহমান যথার্থই লিখেছিলেন—

‘আস্তাবলের দিকে অন্ধকার, ঝুলছে নিষ্কম্প স্তব্ধতা;
আর সেই বেতো ঘোড়াটা অনেকক্ষণ ধরে ঝিঁমোচ্ছে
নিঃশব্দ কোনো আফিমখোরের মতো, মাঝে মাঝে শুধু
ফোলা পা নাড়ছে ঘাড় বাঁকিয়ে।’ (সেই ঘোড়াটা)

আমাদের ঢাকা শহর এখন এর চেয়ে ভালো নেই। আর এসব আবর্জনা নিয়ে যে বাণিজ্য আর রাজনীতি হচ্ছে কিছুকাল ধরে, তার খাতা মেলে দেখলে বিস্ময়ে আপনার চোখ কপালে উঠবে! ঢাকা শহরে বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে অর্থ লুটপাটের বিশেষ কারবার। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বসবাসকারী সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বছরে অন্তত ৪৫০ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন। (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯) সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এঁদের ওপর দুই সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। এর অর্থ, এরা যা ইচ্ছা তা-ই করছে আর এভাবেই চলতে থাকবেন। দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজধানীতে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ নিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে যা বছরে ২৪০ কোটি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাজধানীর এই ময়লা সংগ্রহ করা হয় এবং সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিতে হয়।

এ টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে? স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন, আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী বা তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা এ ময়লা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ টাকা আদায়ের রসিদও তাঁরা দেন না। এমনকি সংগ্রহ করা টাকার কোনো অংশই সিটি করপোরেশন পায় না। আর এই বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় জবরদস্তি করে ময়লা সংগ্রহের কাজ এবং এলাকা দখলের মতো ঘটনা ঘটে বলে পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি।

পত্রিকার প্রতিবেদন ও ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পারি, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে কলাবাগান এলাকায় প্রথম বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পরে পুরো রাজধানীতে একই রকম ব্যবস্থা চালু হয়। প্রথমে যখন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করা শুরু হয়, তখন ময়লা সংগ্রহকারীকে দিতে হতো ১০ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে সিটি করপোরেশন ৩০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয়। তবে সিটি করপোরেশন এই টাকার কোনো ভাগ পায় না। সেই ফি এখন ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় ঠেকেছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে এই ফি আরও বেশি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও বাড়বে। শুরুতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, এলাকার ব্যক্তিরা মিলে সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি করতেন। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ যেহেতু নেই, তাদের দায়ও নেই বলে তারা হয়তো মনে করছে।

বেসরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান ময়লা সংগ্রহ করে তাদের একটি সংগঠন রয়েছে; নাম প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডারস (পিডব্লিউসিএসপি)। এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত। সংগঠনটি নাগরিকের সুবিধা দেখুক বা না দেখুক, বছর বছর ময়লা নেওয়ার জন্য ফি বাড়ানোর প্রস্তাব করে। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে অনেকেই হয়তো বড়লোক হচ্ছেন। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সিটি করপোরেশন শুধু নির্ধারিত জায়গায় রাখা ময়লার কনটেইনার এবং ময়লা রাখার ঘর বা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে ময়লা সংগ্রহ করে।

এবার বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে নজর দেওয়া যাক। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে গৃহস্থালি ও দোকান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন ময়লা তৈরি হয়। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। অথচ সিটি করপোরেশন চাইলে রাজধানীর বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে এমন বাণিজ্য বন্ধ করতে পারত। আমরা জানি, বর্জ্য সংগ্রহে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী সিটি শৃঙ্খলা এনেছে। এই দুই সিটি করপোরেশন নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ করে। আর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতিবছর গৃহকরের ৩ শতাংশ নেয় পরিচ্ছন্নতা বাবদ। গত অর্থবছরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ১৫০ কোটি টাকার বেশি পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করেছে। অথচ তারা বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ না করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে। তাহলে এই পরিচ্ছন্নতা করের টাকা কি শুধু সকালে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ায় ব্যয় হয়ে যায়?

অনেক দিন ধরেই আমরা দেখেছি, প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ঢাকা মহানগরীকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করা থেকে সবুজ ঢাকা, বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন মেয়রপ্রার্থীরা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয় না কখনোই। এ রকমই কি চলবে? সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের খুব কমই রাস্তার ময়লা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটি ঠিকভাবে করেন। অভিজাত হিসেবে পরিচিত নয়, এমন সব এলাকার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সড়কের আশপাশে ময়লা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। পরিষ্কার করার নামটি কেউ করে না। একসময় এসব ময়লা মাটির সঙ্গে মিশে যায় কিংবা ড্রেনে পড়ে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাসাবাড়ির ময়লা দূর হলেও রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই করুণ। শহর পরিচ্ছন্ন না হওয়ার জন্য স্বল্প বাজেট ও জনবলের অভাবকে সব সময় দায়ী করে দুই সিটি করপোরেশন। তা-ই যদি হবে, তাহলে প্রথমে করণীয় হচ্ছে বাজেট ও লোকবল বাড়ানো। আর সেটা করা যদি সম্ভব না হয় তাহলে বেসরকারিভাবে বাসাবাড়ি থেকে যেভাবে টাকার বিনিময়ে ময়লা সংগ্রহ করা হচ্ছে, একইভাবে রাস্তাঘাট, অলিগলি পরিষ্কারের কাজটিও বেসরকারিভাবে করা যেতে পারে। ন্যায্য ও যুক্তিসংগত ফির বিনিময়ে এটা করা যেতেই পারে। শহরটা তো অন্তত পরিষ্কার থাকবে। তবে এই রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার অছিলায় যাতে আবার কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য না হয়, সেটাও দেখতে হবে।

তবে নগর অপরিচ্ছন্ন থাকার সব দায় সিটি করপোরেশনগুলোর ওপর না দিয়ে নিজেদের দিকেও তাকাতে হবে। আমরা নগরবাসী সবাই কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি? এই নগরটা এত নোংরা হয় সে আমরা করি বলে। আমাদের অনেকের স্বভাব হচ্ছে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা। আমাদের স্বভাব বদলানোর ব্যাপারটা আমাদের হাতে। আমরা নিজেদের একটু বদলাতে পারি না?

*লেখক: কবি ও কলামিস্ট