তাজমহলের উপাখ্যান: কতটা প্রেম, কতটা ঘৃণা

শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। ছবি: মোসাব্বের হোসেন
শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। ছবি: মোসাব্বের হোসেন

আগ্রার যমুনা নদী দিয়ে যুগে যুগে জল গড়িয়েছে অনেক। স্রোতের প্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাজমহলের প্রেমের স্তুতি পৌঁছে গেছে বিশাল এই দুনিয়ার প্রতিটি আনাচ-কানাচে। প্রেমের উত্তাল মহাসমারোহের ভেতরেও কোথা থেকে যেন একটি কালো রঙের স্রোতও খুবই ক্ষীণ আকারে বহমান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই ক্ষীণকায় স্রোতপ্রবাহ প্রেমের সেই বিশালাকার ধারার সঙ্গে কখনোই পাল্লা দেওয়ার চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশে সমর্থ হয়নি। তাজমহল তাই তো এখন অসীম এক প্রেমের সমার্থক শব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়।

ইলিশ মাছ স্বাদে এবং গুণে অতুলনীয়, কিন্তু অধিকাংশ মাছের তুলনায় তার শরীরে কাঁটার পরিমাণও কিন্তু অত্যধিক বেশি। তাজমহলের তুলনাও অনেকটা ইলিশের মতোই। তার বিশ্বনন্দিত প্রেমের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ঘৃণার অভিব্যক্তি।

‘prince of builders’-খ্যাত শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল আর তাঁর প্রেমের গল্পগুলো তো সবাই জানি, কিন্তু তাজমহলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তীব্র ঘৃণার গল্পগুলোর কতটুকু জানি আমরা?

মোগল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন বেশ বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি তাঁর শুধু ঝোঁকই ছিল না; বরং তা রীতিমতো এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলস্বরূপ ভারতবর্ষজুড়ে গড়ে উঠেছিল এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা এখন পর্যন্তও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের দৃষ্টিকে ভারতের দিকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে।
ইতিহাসের ধূসর পাতা সাক্ষ্য দেয়, তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৬৩২ সালের শুরুতে। ১৬৪৭ (মতান্তরে ১৬৫৩)-এর দিকে বাস্তব রূপ লাভ করে শাহজাহানের স্বপ্নের স্থাপত্য।

আরজুমান আরা বেগমের সঙ্গে খুররমের (যিনি পরবর্তী সময়ে শাহজাহান নামে পরিচিত হন) প্রথম দেখা হয় ১৬০৭ সালে। তাঁর অপরূপ স্নিগ্ধতায় মোহিত হয়ে যান ১৫ বছর বয়সী শাহজাহান, যাকে বলে প্রথম দর্শনেই প্রেম। এরপর খুব তড়িঘড়ি করে সেই বছরেই বাগদান সম্পন্ন হয়।

আরজুমান আরার পিতৃকুল ছিলেন পারস্যের বেশ সমৃদ্ধিশালী পরিবার। তাঁর বাপ-দাদারা মোগলদের দরবারে বেশ সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহান ছিলেন আরজুমানের ফুফু। এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যেতেই পারে, আরজুমান মোগল সম্রাজ্ঞী হওয়ার জন্য একেবারে অযোগ্য ছিলেন না।
বাগদানের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৬১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাঁদের। শাহজাহান তাঁর নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল’ (chosen one of the palace /pearl of the palace) নামে। নামের ভেতরেই ফুটে উঠে তাঁর প্রতি শাহজাহানের সীমাহীন ভালোবাসা। পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্বের কাছে তিনি আজও মমতাজ মহল নামেই পরিচিত হয়ে আছেন।

তবে মমতাজ কিন্তু শাহজাহানের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শাহজাহানের অন্তত আরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন, এমনকি মমতাজের পরও তিনি আরও একটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই যুগের সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধারণা করা হয়, রাজনৈতিক কারণেও শাহজাহান একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করে থাকতে পারেন। কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায় যে মমতাজের নাকি আগে একবার বিবাহ হয়েছিল, শাহজাহানের হস্তক্ষেপেই নাকি সেই সম্পর্কের অবসান ঘটে এবং তারপরের গল্প আমাদের সবারই জানা। তবে শাহজাহান যে মমতাজকেই অন্য সবার চেয়ে অধিকতর বেশি ভালোবাসতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয় ১৯ বছর। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে অসীমের পথে পাড়ি দেন ভালোবাসার প্রতিমা মমতাজ মহল।

মাত্র ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে মমতাজের কোলজুড়ে আসে ১৪ সন্তান। তাঁর মৃত্যুও হয় ১৪তম সন্তান প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে। এই তাবৎ দুনিয়ার অন্যতম কঠিন কাজ হলো মায়েদের প্রসববেদনা। মাত্র ১৯ বছরে মমতাজকে গুনে গুনে ১৪ বার সেই বেদনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করতে হয়েছে, এমনকি শেষবারে যমদূত এসে তাঁকে স্বর্গের ঠিকানা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। অনেকে তো কৌতুকের ছলে বলেই ফেলেন…শাহজাহানের কাছে প্রেমের সংজ্ঞা ছিল বছরান্তে একটি করে সন্তান!

১৬৩১ সালে মমতাজ মহলের অকালপ্রয়াণে বেশ ভেঙে পড়েন শাহজাহান। বছর দু–এক নেহাত প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে নাকি কথাও বলতেন না। চরম বিরহ তাঁর তেজদীপ্ত জীবনকে হঠাৎ যেন বার্ধক্যের জড়তায় স্থবির করে তুলল। আমৃত্যু সেই শোকের ছায়া পরিলক্ষিত হতো তাঁর বিষণ্ন চাহনিতে। তবে নারীপ্রীতি যে একেবারেই উবে গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি নয়। শোনা যায়, মমতাজের মৃত্যুর বছর পাঁচেক পর তাঁরই ছোট বোনের সঙ্গে নাকি বিবাহবহির্ভূত অন্তরঙ্গ এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঠিক এ জন্যই অনেকে শাহজাহানের অসীম প্রেমের দিকে আঙুল তোলার অবকাশ খুঁজে পান।

শাহজাহানের শৈল্পিক মন যেমন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল প্রবল। ছবি: মোসাব্বের হোসেন
শাহজাহানের শৈল্পিক মন যেমন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল প্রবল। ছবি: মোসাব্বের হোসেন

২০ হাজার সুদক্ষ কর্মীর দেড় যুগ ধরে রাত-দিন চরম খাটুনির ফসল তাজমহল। তাজমহলের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটি ঘটল এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। শাহজাহানের সরাসরি নির্দেশে চোখের ওপর আঘাত করে চিরদিনের মতো অন্ধ করে দেওয়া হলো স্থপতিদের। পাশাপাশি যেসব শ্রমিকের পাথরভাঙা হাতে মস্ত বড় সেই তাজমহলের পত্তন ঘটেছিল, তাঁদের সবার হাতের আঙুল অত্যন্ত নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো।

শাহজাহানের যেমন শৈল্পিক একটি মন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল তাঁর প্রবল। পরবর্তী সময়ে যদি সেসব শ্রমিকের হাত ধরে তাজমহলের মতো অন্য কোনো অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে শাহজাহানের নাম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় এমন চরম বর্বরতার পথ বেছে নেন তিনি। তাজমহলে শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে জগদ্বিখ্যাত যে কারুকার্য খচিত রয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকের ঘাম নয়, মিশে আছে তাজা রক্তও। এসব চিত্র যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন তাজমহলকে প্রেমের নিদর্শন বলতে গিয়ে দ্বিধাবোধ কাজ করলে তা নিশ্চয়ই খুব একটা অযৌক্তিক হবে না।
জীবনের শেষ দিকে এসে নিজ ছেলের নির্দেশে বন্দী করা হয় শাহজাহানকে। মোগলদের আধিপত্য তখন শাহজাহানপুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে। মুকুটহীন বৃদ্ধ শাহজাহান বন্দিশালার এক ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে মাঝেমধ্যে চেয়ে দেখতেন তাঁর সেই অমর কীর্তি।

রোদের আলোয় তাজমহলের দেখা মেলে এক রূপে, সন্ধ্যার গোধূলিলগ্নেই হয়তো আবার অন্য কোনো মায়াবিনী রূপে হাজির হয় সে। আর জ্যোৎস্না রাতে ঝরনা-নহর-বাগানসমেত তাজমহল যেন হয়ে ওঠে স্বর্গেরই প্রতিচ্ছবি।

আলো-আঁধারির এসব খেলা দেখতে দেখতে হয়তো মৃত্যুপথযাত্রী শাহজাহানের চোখে দু-এক ফোঁটা জল চলে আসত। চোখের জলেই হয়তো স্মরণ করার চেষ্টা করতেন তাঁর অতীত গৌরবগাথা। হয়তো তখন অদৃশ্যলোক থেকে বিনীত এক আহ্বান ভেসে আসত প্রাণাধিক মমতাজ মহলের কাছ থেকে।

তাজমহলকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার অংশটুকুই বড় ছিল, নাকি ঘৃণার—এ বিতর্ক হয়তো চিরকাল থাকবে। থাকবে নানা যুক্তিতর্ক, আর তর্কের খাতিরেই সৃষ্টি হবে নিত্যনতুন বিতর্ক। মূলত এসব বিতর্কও একধরনের সৌন্দর্য। বিতর্ক আছে বলেই তো তার প্রতি গোটা দুনিয়ার আকর্ষণও আছে, যে আকর্ষণের ইশারায় সাড়া দিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ছুটে যায় আগ্রার যমুনার তীরে।

শেষ করব রবির ভাষাতেই…

হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা
যেন শূন্যদিগন্তের ইন্দ্রজাল ধনুচ্ছটা,
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়