বরিশালে 'বিলুপ্ত' শব্দটি বাঁচিয়ে রেখেছে কালোমুখ হনুমান

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সামনে কালোমুখ হনুমান। ছবি: লেখক
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সামনে কালোমুখ হনুমান। ছবি: লেখক

আট বছর ধরে নগরী চষে বেড়াচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় একটি কালোমুখ হনুমান। কীভাবে, কোথা থেকে হনুমানটি এসেছে, তা কেউ বলতে পারেন না। কেউ বলছেন, এটি যশোর থেকে এসেছে। কারণ, এ ধরনের হনুমানের দেখা সাধারণত যশোরের কেশবপুর এলাকায় মেলে। হনুমানের কলা খুব পছন্দ। সেই ধারণা থেকে অনেকে আবার মনে করেন, কলাবোঝাই কোনো ট্রাকে করে বরিশালে এসেছে হনুমানটি।

আবার অনেকের ধারণা, বরিশালেই এর জন্ম। আজ এই এলাকায় তো কাল অন্য এলাকায় গিয়ে নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কালোমুখ হনুমানটি। কয়েক বছর পর ১১ অক্টোবর শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সামনে চোখে পড়ে হনুমানটি। ওই দিন মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে সকাল সাড়ে আটটা থেকে মেডিকেল কলেজ কম্পাউন্ডে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা ভিড় করেন। সকাল থেকে কলেজের পেছনের গেটের প্রাচীরের ওপর বসে ছিল হনুমানটি। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীকে দেখতে শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেন। একজনকে দেখা গেল কলা দিয়ে হনুমানটিকে আপ্যায়ন করাতে। কলা পেলে খুব আনন্দিত হয় এ ধরনের প্রাণী। ধূসরসাদা লোমে ভরা হনুমানটি অনেকটা শান্ত স্বভাবের। তবে কেউ ইট কিংবা ঢিল ছুড়লে ভয়ে স্থান পরিবর্তন করে।

মেডিকেল কলেজের সামনে আবু জাফর নামের এক অভিভাবক জানান, তিনি প্রাণীটিকে এর আগে নগরের নাজিরপুল, বিএম কলেজ, মুন্সির গ্যারেজ, বৈদ্যপাড়া, সিঅ্যান্ডবি রোড, কালিজিরা, বাংলা বাজার, স্ব-রোড, আমানতগঞ্জসহ একাধিক এলাকায় দেখেছেন। অনেকে বলছেন, হনুমানটি শুধু নগরী নয়, আশপাশের অনেক উপজেলায় ঘুরে বেড়ায় খাবারের সন্ধানে। অপর এক অভিভাবক বললেন, প্রাণীটি মনে হয় খাবারসংকট ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছে।

আট বছর ধরে নগরী চষে বেড়াচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় একটি কালোমুখ হনুমান। ছবি: লেখক
আট বছর ধরে নগরী চষে বেড়াচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় একটি কালোমুখ হনুমান। ছবি: লেখক

বরিশাল বিএম কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘বইয়ে সাত প্রজাতির হনুমানের কথা উল্লেখ রয়েছে। বরিশালে যে হনুমান দেখা যাচ্ছে, সেটা সিমনো পিথেকাস প্রজাতির। ইংরেজি নাম “ব্লাড ফুটেড ল্যাংগুর”। এদের লোম ধূসর বর্ণের এবং মুখ কালো। হনুমান একসময় আমাদের বরিশালেই অনেক দেখা যেত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বরিশালে কয়েক বছর ধরে দু–একটি হনুমানের দেখা আমিও পেয়েছি। দুই বছর আগে আমাদের বিএম কলেজেই দুটি হনুমানের দেখা মেলে। মানুষ এদের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বাঁচতে দিতে চায় না। ইটপাটকেল ছুড়ে অনেকে তাড়িয়ে দেয়। হনুমান ভিতু প্রাণী। এরা লজ্জা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে। তবে বাঘ বা শিয়ালের মতো হিংস্র না।’ হনুমান বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষ ওদের আবাসস্থল ধ্বংস করেছি। আমাদের নিজেদের থাকার ঘরবাড়ি করার জন্য গাছপালা ধ্বংস করছি। এর ফলে ওদের প্রজননক্ষেত্র নেই। বাচ্চা হলে লালনপালনের পরিবেশ নেই। বইয়ের ভাষায় “গেম রিজার্ভ” বলে একটা বিষয় আছে। সেখানে বলা আছে, বন্য প্রাণী মনের মতো করে চলবে। সেই পরিবেশ একসময় ছিল, এখন নেই। হনুমান ফলমূল বেশি খায়। কিন্তু ফলের গাছ কমে যাচ্ছে। যে কারণে খাদ্যসংকটে এসব প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।’

মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের যেমন চারটি প্রকোষ্ঠ, তেমনি হনুমানদেরও চারটি প্রকোষ্ঠ। মানুষের মতো তারাও স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদেরও শরীরে লোম আছে, লেজটা অনেক লম্বা। প্রজননের এবং খাদ্যের পর্যাপ্ত অভাবের কারণে দেশ থেকে হনুমানের মতো অনেক প্রাণীই হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে। আজকে যেখানে সুন্দরবনে হামলা হচ্ছে, সেখানে আমাদের এখানকার কথা দূরে থাক। এসব প্রাণীর অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে সবার আগে আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে।’

বরিশাল সামাজিক বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, খুলনায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ রয়েছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করা তাদের কাজ।

খুলনা বন সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মদিনুল হাসান বলেন, কালোমুখ হনুমান যশোরের কেশবপুর ছাড়া আর কোথাও নেই। এটা মুক্তভাবে থাকতে ভালোবাসে। হয়তো কোনো ট্রাকে করে বরিশালে গিয়ে রয়ে গেছে।