'ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও, মজার মজার মাছ খাও'

শৈল্পিক কারুকার্যে সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যন্ত্রটিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘পলো’ বলে। ছবি: লেখক
শৈল্পিক কারুকার্যে সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যন্ত্রটিকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘পলো’ বলে। ছবি: লেখক

তলাবিহীন কলসির আদলে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে ছোট ছোট ছিদ্র রেখে শৈল্পিক কারুকার্যে সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যন্ত্রটির আঞ্চলিক নাম ‘পলো’। এ পলো দিয়ে মাছ ধরাকে বলা হয় ‘পলো বাওয়া’।

শীতের সময় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরে পানি কমে গেলে দলে দলে লোক পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামেন। এখনো পলো দিয়ে মাছ ধরা আছে, তবে আগের মতো নয়। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে পলো দিয়ে মাছ ধরা।

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মালিঝিকান্দার গ্রামের বৃদ্ধ রুহুল আহমেদ (৭৫) বলেন, ‘সেই মাছও নেই, পলোও নেই।’ আগে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই থাকত দু-একটি পলো। পলো মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগি ধরে রাখার জন্যও ব্যবহার করা হতো। শুকনো মৌসুমে, বিশেষ করে কার্তিক থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুরু হয়ে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরার মহড়া। এমনই একটি দৃশ্য দেখা মিলল মালিঝি নদে মাছ ধরার শতাধিক লোকে সমাগমে। মাছ ধরার উৎসব দেখার মজাই অন্য রকম।

ফুলপুর ডোবা-বিল, কঁচোয়া বিল, মাড়ার বিল, ইছামতী নদী, রওয়ার বিল, মালিঝি নদসহ প্রত্যন্ত এলাকার বিল, হাওর, খাল, পুকুরসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে আগেই দিনক্ষণ ঠিক করে আশপাশের প্রত্যেক গ্রামের জনসাধারণকে দাওয়াত দেওয়া হতো। নির্দিষ্ট দিনে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গ্রাম থেকে শৌখিন মৎস্যশিকারিরা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জড়ো হতেন। জলাশয়ের এক প্রান্ত থেকে সবাই একই সঙ্গে লাইন ধরে লুঙ্গি আটঘাট করে বেঁধে অথবা ‘কাছা’ দিয়ে একসঙ্গে দল বেঁধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু করতেন। সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতেন সামনের দিকে। অনেকেরই মাথায় থাকত গামছা বাঁধা। চলত পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক ঝাঁপ দেওয়া আর হইহুল্লোড় করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া। মৎস্যশিকারিরা মাছ ধরেছেন আর মনের আনন্দে ভাটিয়ালি গান গাইছেন। আবার কেউ কেউ জারিগান গাইছেন—‘ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও, মজার মজার মাছ খাও’।

শীতের সময় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরে পানি কমে গেলে দলে দলে লোক পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামেন। ছবি: লেখক
শীতের সময় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরে পানি কমে গেলে দলে দলে লোক পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামেন। ছবি: লেখক

পলো দিয়ে মাছ ধরা যেন নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় এক দৃশ্য। মাছ পড়লেই পলোর ভেতর নাড়া দিত। এতে বোঝা যেত শিকার এবার হাতের মুঠোয়। তখন পলোটিকে কাঁদা মাটির সঙ্গে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখা হতো যাতে নিচের কোনো দিকে ফাঁক না থাকে। এরপর ওপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনা হতো সেই মাছ।

পুরোনো মৎস্যশিকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পড়ে। রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, কালবাউশ, বোয়াল, শোল, চিতল, টাকি, গজার প্রভৃতি মাছও ধরা পড়ে। মাছ দিয়ে মালার মতো তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতেন মৎস্যশিকারিরা।

বর্তমানে অনেক হাওর, খাল, বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসিক প্লট, ফ্ল্যাটসহ নানা স্থাপনা। কোথাও কোথাও কিছুটা জলাশয় থাকলেও আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না এবং আগের অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে, এর বেশির ভাগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সেদিন বেশি দূরে নয়, হয়তো উন্মুক্ত জলাশয়ে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুধু স্মৃতি হয়েই রবে অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো চিনবেই না পলো দিয়ে কীভাবে মাছ ধরতে হয়।

পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পড়ে। ছবি: লেখক
পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পড়ে। ছবি: লেখক

কোলিরকান্দা গ্রামের আইয়ুব আলী (৮০) স্মৃতি ঘেঁটে বললেন, ‘হাক-পাতা কত খাই, তাজা মাছ ধরতে যাই’, ‘শুঁটকিভর্তা কত খাই, বোয়াল মাছ ধরতে যাই’, ‘ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও, মজার মজার মাছ খাও’—মালিঝি নদে পলো দিয়ে মাছ ধরার অভিযানে নামার স্লোগান এগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে পলো নিয়ে মাছ ধরা। নতুন প্রজন্মের জন্য এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।