বিশ্ব কবিতার বিস্ময় বালক কবি র‍্যাঁবো

ফরাসি কবি জাঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবো। ছবি: সংগৃহীত
ফরাসি কবি জাঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবো। ছবি: সংগৃহীত

১০ নভেম্বর। আজ হতে ১২৮ বছর আগের এমন দিনে, কবিতার এক বিস্ময় বালক মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ইতি টেনেছিলেন। ফরাসি কবি জাঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবো পৃথিবীব্যাপী প্রকৃত কবিতাপ্রেমীদের কাছে এক বিস্ময়। ছোট্ট জীবনটায় কবি রচিত মাত্র দুটি কবিতার বই, আর সব মিলিয়ে এই গ্রহের মানুষ তাঁর কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছেন কোনোভাবেই ৮০টির অধিক নয়। র‍্যাঁবোর বিচিত্র আর পলায়নমুখর জীবন এবং জীবনমুখী কবিতাগুলো রচনাশৈলীতে নতুনত্ব, প্রথা ভাঙা লেখা হিসেবেই কবিতার মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পেতেছে।

বিশ্বসাহিত্যে র‍্যাঁবোকে একই সঙ্গে সবচেয়ে নন্দিত ও নিন্দিত কবিদের একজন হিসেবে ধরা হয়। তাঁর রচনা একদিকে অনেকে সরাসরি নাকচ করেছেন, আবার সে রচনাকে অনেকে আত্মস্থ করেছেন, বর হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যুগের পর যুগ কাটাচেড়া করেছেন, সাধনা গবেষণা করেছেন বহু দেশের, বহু ভাষার বহু বহু কবি-সাহিত্যিক। উনিশ শতকে তাঁর সমসাময়িক খ্যাতিমান ফরাসি কবি ও গল্পকার আলফানস ডি লা মারটিন, ভিক্টর হুগো, শার্লে বোদলেয়ার, পল ভ্যালেরি ও স্টেফান মালার্মের সঙ্গে র‍্যাঁবো এককাতারে উচ্চারিত হন।

১৮৫৪ সালের ২০ অক্টোরর বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চলের শার্লভিল শহরে জন্ম জাঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবোর। বাবা সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ফ্রেদেরিক র‍্যাঁবো। মা ভিতালি কুইফ ফ্রান্সের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আরডেইনাস পরিবারের একজন নারী। তাঁরা পুত্রের নাম রাখলেন—জঁ নিকোলা আর্তুর র‍্যাঁবো। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে র‍্যাঁবো তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান।

ধার্মিক ও দায়িত্বপরায়ণ পিতা ফ্রেদেরিক ভিতালি কুইফের হাতে সন্তানদের দায়িত্ব তুলে ১৮৬০ সালে সংসার ত্যাগ করেন। মা–বাবার বিচ্ছেদ না হলেও, এরপর তাঁরা চিরবিচ্ছিন্ন জীবনই যাপন করেছেন। মায়ের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন ও ধর্মীয় অনুশাসনে কবি একপর্যায়ে অতিষ্ঠও হয়ে উঠেছিলেন।

খুব অল্প বয়সেই র‍্যাঁবো ফরাসি, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা রপ্ত করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে লাতিন ভাষায় ৬০ লাইনের একটি কবিতা লিখে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ানের ছোট ছেলের কাছে। কবিতাটির কোনো অনুলিপি পরে আর পাওয়া যায়নি।

র‍্যাঁবোর কবিজীবন ১৮৭০-৭৪ মূলত, এই পাঁচ বছরই। ১৮৭৩ সালে লেখা ‘নরকে এক ঋতু’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কবির বিদ্রোহী ও বাউণ্ডুলে স্বভাবের পরিচয় মেলে কবিতাগুলোয়। কবির যেটুকু রচনা নষ্ট করার সুযোগ পাননি, সেটুকুই আমরা পেয়েছি। বিষয়টি হলো চিরবাউণ্ডুলে, খ্যাপা মন নিয়ে বেড়ে ওঠা কবি নিজের লেখা বহু কবিতা, বহু পাণ্ডুলিপি একবার পড়েই ছিঁড়ে ফেলতেন। এটিকে তিনি একটি মজার খেলায় পরিণতও করেছিলেন। নইলে তাঁর আরও কিছু কবিতা হয়তো এই গ্রহবাসী পেত।

সব কবির মতো র‍্যাঁবোও প্রথম দিকে অন্ত্যমিলবিশিষ্ট কবিতার মাধ্যমেই লেখা শুরু করেন। লেখালেখির শেষ দুই বছর তিনি গদ্য কাব্য রচনা করেন। ২০ বছর বয়সেই ঘোষণা দিয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। লেখা ছেড়ে দেওয়ার পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল, ‘নরকে এক ঋতু’র পর আসলে আর নতুন কিছুই তাঁর লেখার নেই। তাঁর যা বক্তব্য, যা কিছু তিনি কবিতার মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন, তার সবই সে গ্রন্থেই বলেছেন। অবশ্য এরপর ১৮৭৪ সালে তিনি ‘বোধি’ নামে তাঁর কাব্যগ্রন্থ, গদ্য কাব্যে লিখেন। সেটির পর তিনি আর কবিতা লেখেননি।

কবিতা বিষয়ে র‍্যাঁবোর ধারণা বর্তমান সময়ে কবি ও কবিতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা লেখা যায় না, লেখা হয়। কবিতাকে কবি লেখেন না, বরং কবিকে মাধ্যম করে কবিতা রচিত হয়। অর্থাৎ যাঁরা কবি জন্মগতভাবেই কবি, জোর করে অন্তত কবি হওয়া যায় না। তিনি মনে করতেন, কবি হচ্ছে মিস্টিক বা আত্মাগতভাবে বাউলমনের অধিকারী, নিজের শরীর ও মনকে তাঁরা নিয়োজিত করেন অজানার সন্ধানে। সেটির সন্ধান পেয়ে কবি সেটাই তাঁর বর্ণনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য তুলে ধরেন। প্রচলিত ভাষার শব্দভান্ডার যেহেতু অজানা জগতকে বর্ণনা করতে যথেষ্ট নয়, তাই কবিরা বিভিন্ন রকম উপমার ব্যবহার করেন। তবে উপমা থাকলেই সেটা কবিতা নয়। উপমা কবিতার কেবল একটি উপাদানমাত্র। ছন্দ বাক্য আর কবির অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মিশ্রণে একটি কবিতার সৃষ্টি হয়।

বাস্তব জগৎ থেকে সন্ধান পাওয়া যে কবির জগৎ যত বেশি ভিন্ন হয়, ততই উপমা দুর্বোধ্য হতে থাকে। আর এভাবে দুর্বোধ্য হতে হতে কবিতা একসময় হয়ে উঠে পরাবাস্তব।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে, ১৮৭০ সাল থেকে র‍্যাঁবো বাড়ি থেকে পালানো শুরু করেন। শুরু করেন অর্থাৎ এর পরও বহুবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন আবার বহু বহুবার পালিয়েছেন। বহু বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আর বিস্ময়কর হলেও সত্য সেগুলোর বেশির ভাগ পায়ে হেঁটেই। ১৮৯১ সালের ১০ নভেম্বর সকাল ১০টায় কবিতার এই বোহেমিয়ান বালক, চিরবাউণ্ডুলে কবি, তাঁর ৩৭ বছরের বিচিত্র জীবনে শেষনিশ্বাসটি নেন।

*লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক