হুমায়ূন আহমেদ বচনামৃত: প্রমাণসহ কতিপয় উপপাদ্য

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

উপপাদ্য ১.

‘অধিকাংশ মানুষ কল্পনায় সুন্দর, অথবা সুন্দর দূর থেকে। কাছে এলেই আকর্ষণ কমে যায়। মানুষই একই। কারও সম্পর্কে যত কম জানা যায়, সে তত ভালো মানুষ।’ (হুমায়ূন আহমেদ)

দূর থেকে কাশবন দেখেছেন কখনো! পাহাড়! দুই গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হয় না, ওমা কী সুন্দর! হয়ই তো।

যখন সেই মেঘের মতো ঘন একই সে কাশবন, ছলনাময়ী সুন্দর একই সে পাহাড়ের যত কাছে যাওয়া হয়, পূর্বের দৃশ্যমান সৌন্দর্যে বিন্দু বিন্দু মলিনতা এসে জমা হতে শুরু করে। আরও কাছাকাছি, একেবারে কাছে গেলে সেই কাশবন ছিপছিপে কঞ্চির বন, উঁচু পাহাড়টিই এবড়োখেবড়ো মাটির ঢিবিই মনে হয়। মানুষও এমন।

একজন মানুষকে যখন দূর থেকে দেখতে পাই, আমরা দেখি তার চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা ইত্যাদি। যখন সে মানুষটিরই কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়, তখন দেখা যায় ভেতরের মানুষটাকে; তার স্বভাবচরিত্র, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস, প্রকৃত চালচলনকে। আর তখনই বিপত্তি!

একজনকে দূর থেকে দেখে তার সম্পর্কে জানা, আর কাছে থেকে তাকে জানা এক রকম হয় না। শতভাগ ক্ষেত্রে না জেনেশুনে, না মিশে একজন সম্পর্কে আরেকজন যা ভেবে থাকে, ভুল হয়। দূর থেকে ভালো লাগে যাকে, কাছাকাছি হলে তার সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।

ঘুমোনোর সময় মহিষের মতো নাক ডাকে, টয়লেট সারতে আঙুল দিয়ে ঠেসেঠুসে মুখ ভরে গুল মাখে, বাইরে খাওয়ার সময় স্পুন ব্যবহার করে, বাসায় খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আরে থো তোর চামুচচুমুচ। ভাত দে আগে...’ (কখনো বোনাস হিসেবে সঙ্গে একখানা গালি)। আবার বিয়ের আগে রিকশা ভাড়া, খাবারের বিল দিতেই পারতেন না, বিয়ের পর হাত কখনোই তার মানিব্যাগ পর্যন্ত পৌঁছায় না, শাহবাগ থেকে টাটকা ফুল—পারলে বঙ্গভবনের বাগান থেকেই যে তাজা ফুল ছিঁড়ে এনে খোঁপায় গুঁজে দিত, সে-ই ফুল বলতে চিনে প্লাস্টিকে বানানো ফুল—বারবার যেটা ব্যবহার করা যায়, যদিওবা জীবিত ফুল আনেই, পুরো গাছই নিয়ে হাজির—এই উটকো খরচটা পরের বছর যাতে বাঁচে, কামিনী ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা হতো বলে কতবার তা এনে দিত, এখন কামিনী কাঞ্চন ফ্লেভারযুক্ত টয়লেটের মেঝে ঘষার ব্লিচিং পাউডার আনে।

সব মিলিয়ে এটিই কি স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে না, মানুষ দূর থেকে যতই সুন্দর দেখাক, কাছে এলে ভীষণ এবড়োখেবড়ো অথবা কঞ্চিবনের মতো মনে হয়। সুতরাং মানুষ সম্পর্কে যত কম জানা যায় তত উত্তম, সে তত বেশি ভালো মানুষ। (প্রমাণিত)

উপপাদ্য ২.
‘পৃথিবীতে আসার সময় প্রত্যেক মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে…। কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।’
অথবা
‘কিছু কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারও কারও কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেয়!’ (হুমায়ূন আহমেদ)

ঘটনা তো সত্য। আলবত সত্য। সারা জীবন প্যান্টের পকেটে মানুষ আলাদিনের প্রদীপটা নিয়ে আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এটা খুঁজে ওটা খুঁজে, ভনভন করে ঘুরতে থাকে। একটা কাজের জন্য এরে-ওরে ধরনাদারি, তদবির, দৌড়াদৌড়ি, মামদোবাজি তো চলতেই আছে। হুঁশ নেই, দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে ফাউ অথচ নিজ পকেটে হাত দিচ্ছে না। এর-তার কাছে না ছুটে প্রদীপে ঘষা দিয়ে আলাদিনের দৈত্য সাহেবকে ডেকে এনে, তাকে যে নির্দেশ দিয়ে কাজটি করাবেন, সে খেয়াল নেই। মানুষের নিজের ওপর বিশ্বাসের মধ্যেই তো সেই প্রদীপ। সমস্যা হলো, দিনকে দিন মানুষ কেন জানি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েই চলেছে। পকেটে প্রদীপ যে আছে, সেটাই জানে না, আলাদিনের প্রদীপ বহু দূরেই রইল। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ স্যার হয়তো জানতেন তাঁর পকেটে প্রদীপ আছে। কারণ, তিনি সব সময়ই ছিলেন নিজ বিশ্বাসে রাজার রাজা।

হুমায়ূন স্যার প্রদীপটি পেয়েছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, সম্মানের চাকরি, নিশ্চিত জীবন, প্রতিপত্তি—কোনোটিরই অভাব যেখানে ছিল না, দ্বিতীয়বারের জন্য চিন্তা না করে সেটাকেই ছেড়ে দেওয়া। একজন মানুষ পড়াশোনা করলেন সারা জীবন, ভালো ফল করলেন, বাইরে গিয়ে বড় ডিগ্রি অর্জন করলেন—খুব স্বাভাবিক সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পেশাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিতে চাইবেন, বেশির ভাগ মানুষ তা-ই করে। হুমায়ূন স্যার তা করলেন না। চার বাচ্চা, এক বউ আর পুরো পরিবারের ভার হাসিমুখে মাথার ওপর রেখে, অবলীলায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিলেন! বেছে নিলেন লেখালেখিকে পথ হিসেবে; গল্প-উপন্যাস লিখবেন, নাটক, সিনেমা, গান বানাবেন। কোনো সময়ে এমন একটি পেশা তিনি বেছে নিলেন, যখন এ দেশে এত এত টেলিভিশন চ্যানেল আসেনি। তখনো সিনেমা হলগুলোতে নতুন সিনেমার প্রথম শো থেকে ছারপোকারা থাকত মূল দর্শক। সেই লাইনে হুমায়ূন আহমেদের ভবিষ্যৎ কী, সেটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর জানা ছিল না। তবু তিনি হুমায়ূন আহমেদ, তিনি অচেনা পথেই হাঁটলেন।

সাধারণ মানুষ, যারা আলাদিনের প্রদীপ খুঁজে পায় না, তারা অন্তত নিশ্চিত জীবন ছেড়ে অনিশ্চয়তার হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার সাহস রাখে না। হুমায়ূন দিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করে গিয়েছিলেন, তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।

সফলতা দুটি কারণে হতে পারে—হয় ভাগ্যকে নিজ হাতেই গড়তে জানতেন, অথবা তাঁর পকেটে যে আলাদিনের প্রদীপ আছে, সেটা খুঁজে পেয়েছিলেন। (প্রমাণিত)

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ


উপপাদ্য ৩.
যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে, তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় যে সব ঠিক হয়ে যাক। কিছুদিন পর সে সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়। আর অনেক দিন পর সে আগের চেয়েও অনেক বেশি খুশি থাকে, যখন সে বুঝতে পারে যে কারও ভালোবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে যায়, কিন্তু কারও অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে যায় না।

— হুমায়ূন আহমেদ স্যারের যাপিত জীবন। (প্রমাণিত)

উপপাদ্য ৪.
ভদ্র ছেলেদের জন্য মেয়েদের মনে কখনো প্রেম জাগে না। যা জাগে সেটা হলো সহানুভূতি। (হুমায়ূন আহমেদ)

দুনিয়ায় যত নাটক, নভেল, সিনেমা কোথাও নায়ককে শুধুই এক সাদামাটা ভদ্র ছেলে হিসেবে দেখা যায়! না। যদি তেমন পাওয়াও যায়, ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ভদ্র ছেলেটির পুচ্ছ দেশে হালকা হলেও একটি লেজ লাগানো আছে এবং সেই লেজ দিয়ে সে রীতিমতো মাছিও তাড়ায়।

প্রেম জিনিসটাই এমন গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে কারও ওপর পড়ে না, প্রেম আনতে হয় ছিনিয়ে, একে জয় করতে হয়। যারা প্রকৃত ভদ্র ছেলে, তারা এসব ছিনাছিনির মধ্যেই নেই। তাই তাদের জীবনে সত্য প্রেম খুব কমই আসে। চোখ বন্ধ করে আমরা চারপাশের ভদ্র ছেলেগুলোর কথা চিন্তা করলে উত্তর পেয়ে যাব। তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে মেয়েরা শুধু ছিনিমিনিই খেলেছে। চোখ বন্ধ করে ভদ্র ছেলেদের সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে, যদি দেখতে না পান, তবে বলতে হবে, আপনার অভিজ্ঞতায় ঘাটতি রয়েছে। ঠিক কি না? (প্রমাণিত)

উপপাদ্য ৫.
‘চাঁদের বিশালতা মানুষের মাঝেও আছে, চাঁদ একজীবনে বারবার ফিরে আসে, ঠিক তেমন মানুষ প্রিয় বা অপ্রিয় যে-ই হোক, একবার চলে গেলে আবার ফিরে আসে।’ (হুমায়ূন আহমেদ)

প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই, আমরা কিন্তু তাঁকে ছাড়িনি। যখন যেখানে যেভাবেই তাঁকে নিয়ে আলোচনা করি, তাঁর কথা বলি, লেখালেখি করি, তার সবই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি ভালোবাসা। তিনি চলে গিয়েও হয়েছেন আরও বিশাল, আরও প্রকট। সেই কবেই চলে গেলেন, অথচ একটিবারের জন্যই কখনো কি মনে হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আছি। হুমায়ূন আহমেদ পৃথিবীতে নেই, তবু তিনি আছেন বাংলার ঘরে ঘরে; ছড়িয়ে যাবেন, ছাড়িয়ে যাবেন, রইবেন বাদশাহ নামদার হয়েই!

হুমায়ূন হলেন সেই চাঁদ, যা বাঙালির জীবন থেকে কখনোই হারাবে না।

* লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক